আগের পর্বঃ ব্যাঙ ও লাওস, নেপালি বাদুর, ইথিওপিয়ার সিংহ, পাহাড়িয়া খাবারদাবার
সাদা চামড়ার লেহ্যপেয়
অংশুমান দাশ
জার্মানরা সাধারণত গোঁফ রাখেন না। কেন, সেটার কোনও সদুত্তর পাইনি এখনও। হিটলারের গোঁফ ছিল অবশ্য, কিন্তু সেই লজ্জাতেই কিনা জানি না, তারপর আর কেউ গোঁফ রাখার চেষ্টা করেননি। যাই হোক, এই আশ্চর্য আবিষ্কার করার সুযোগ হয় অ্যান্ডেক্স নামের এক পাহাড়ের মাথায় এক চার্চে বসে।
জার্মানির বাভারিয়া অঞ্চলে হেরসিং নামের এক ছোট্ট শহরে ছিলাম বেশ কিছুদিন, কাছেই অ্যান্ডেক্স পাহাড়, আর তার মাথায় এক চার্চ, চার্চের সঙ্গে লাগোয়া এক বিয়ার তৈরির কুটিরশিল্প। খ্রিস্টীয় মতে মদ প্রসাদের মত বলে অনেক চার্চের সঙ্গেই বিয়ারের শিল্প আছে। অ্যান্ডেক্স তাদের মধ্যে জার্মানিতে সব থেকে নামকরা। ঘণ্টাদেড়েক হেঁটে হাঁপাতে হাঁপাতে চার্চে ওঠা গেল – অনেকে সাইকেল নিয়ে উঠছেন, নামছেন।
গিয়ে দেখলাম চার্চ ফাঁকা, কিন্তু পানশালায় পা রাখার জায়গা নেই। প্রচুর মানুষ আর তাদের সঙ্গে নানাবিধ কুকুর – ছোট বড় মাঝারি কালো সাদা লোমশ আর অতি লোমশ। বিশাল বড় বড় গ্লাসে আনা পানীয় নিমেষে আসছে ও চালান হয়ে যাচ্ছে – কেউ কেউ বাজি ধরে এক নিঃশ্বাসে এক লিটার পান করে প্রচণ্ড উল্লাসে হা হা করে হাসছে। একটা হাস্কি কুকুর অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে – হয়ত আমার বেমানান মোটা কালো গোঁফ, গাত্রবর্ণ ও মাঝারি উচ্চতা দেখে। তখনই আবিষ্কার করি – আমিই একা গোঁফধারী!
জল না খেয়ে বিয়ার খান বলে সুনাম আছে জার্মানদের – ইয়োরোপের অনেক দেশেই তাই, তবে এ ব্যাপারে একচেটিয়া এরাই। অক্টোবর মাসে মিউনিখ শহরে ‘অক্টোবর ফেস্ট’-এ রাশি রাশি লোক ছুটে আসেন এই সুনামের অংশীদার হতে। আমার অবশ্য সে সুযোগ হয়নি। আমার দৌড় গ্রাম, চাষি, ক্ষেতখামার, ইস্কুল, কলেজ – চাষবাস নিয়ে জানা বোঝা জানানো। সেই সুত্রে সুযোগ হয়েছে নানা খাবার চেখে দেখার, হেঁশেল থেকে, রান্নাঘর থেকে। বাইরে বসে রোদ পুইয়ে পুইয়ে খাওয়ার একটা নেশা আছে ইয়োরোপে। সব রেস্টুরেন্টের সামনে ফুটপাথ দখল করে চেয়ার পেতে রোদে ভাজা হতে হতে খাওয়ায় যে কী মজা আমি বুঝিনি – চোখ মুখ কুঁচকে, খেয়ে গিয়েছি কেবল। তবে ওদের দেশে রোদ ও উত্তাপের অভাব আছে অবশ্য। গ্রামেও বাগানে চেয়ায় টেবিল পেতে খাওয়ার চল প্রচুর।
এয়ারপোর্টে নামা মাত্র এক বিচিত্র চীজ-এর গন্ধ মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে – তারপর পুরো সময়টাই সেই গন্ধ তাড়া করে বেড়ায় দেশময়। লম্বা সময় থাকলে, সেই গন্ধে গা গুলোয়। আমাদের দেশে আমরা ওই এক ধরনের নোনতা চীজ খেয়েই অভ্যস্ত – নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড এর মত দেশে হিসেব পর্যন্ত থাকে না তার রকমফেরে। ছাগল, গরু, ভেড়া, মোষ – পারলে প্ল্যাটিপাসের দুধ দিয়েও চীজ বানায় তারা। কোনটা ঢিমে আঁচে, কোনটা গনগনে আঁচে, কোনটা সকালে, কোনটা বিকেলে, কোনটা আধো ছায়ায়, কোনটা ধোঁয়ায়। বিয়ার, ওয়াইন, কফি আর চীজ নিয়ে ইওরপিয়ানদের কিছু জিজ্ঞেস করা মানে মাথা ঝিমঝিম করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে অবধি তারা থামবেন না।
এ হেন দশা হয়েছিল ইতালির এক ওয়াইন কারখানায় গিয়ে। যে দিকে দুচোখ যায় শুধু আঙুর গাছ, থোকা থোকা আঙুর – ‘আঙুর ফল টক’-এর গল্পের শিয়াল যে ইতালীয় ছিল না তা ইতালি গেলেই বোঝা যায়। ট্রাকে চড়ে আঙুর এলো, ঢুকে গেল মেশিনে। রস নিংড়ে তা ঢুকে যাবে ব্যারেল-এ। মাটির তলায় বি-শা-ল বড় বড় কাঠের ব্যারেল – এক এক রকম কাঠের – ওক-ই প্রধান। যত পুরনো তত তার দাম। পানীয়-র সঙ্গে কাঠের যে এমন সম্পর্ক কে তা জানত! সে নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য শোনার পরে যেতে হল ওয়াইন চাখতে। ছোট ছোট গ্লাসে নানা রকম ওয়াইন আসতে থাকল – বাঙালির বিদ্যার দৌড় লাল ও সাদা ওয়াইন – ব্যাস। তার যে এত রকমফের, নাম, স্বাদ কেই-ই বা জানত। কেউ নাকি খাবার আগে, কাউকে খেতে হয় অলিভ দিয়ে, কাউকে চীজ। কাউকে মাংসর সঙ্গে, তো কেউ ফলের সহচরী। কারো কারো নাকি খাওয়ার পরে স্বাদ পাওয়া যায় – যাকে বলে after taste। বোঝো। একটু পরেই আমার সব গুলিয়ে যেতে থাকে। স্বাদ গন্ধ সব মিলে ভোঁ ভোঁ করতে থাকে, কিছুই বুঝতে পারি না। ইতালিতে বসে ওয়াইনের অসম্মান করব, এমন সাহসও দেখাতে পারি না – সে একেবারে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি কাণ্ড।
একই দশা কফি নিয়ে হয়েছে বেশ কয়েকবার। কফির এতরকম নাম – জানি না, বুঝিও না – তবু অতি কায়দার সঙ্গে একেকবার একেকরকম নাম বলে স্মার্ট হতে যাই। অধিকাংশ সময়েই ঘন কালো রং-এর যে তরলটি এসে হাজির হয়, তা আমি সাঁতরে পেরোতে পারি না। বিকট তিতকুটে স্বাদ – তাই নিয়ে আবার কত তর্ক – আমি পাঁচন গেলা মুখ নিয়ে তাল ঠুকে যাই। আমার এক সহকর্মী ছিলেন জার্মান – তিনি তার মান রাখতে সব জায়গায় কফি মেশিন নিয়ে ঘুরতেন – আর যে হোটেলেই যেতেন, তার বিচিত্র হিন্দিতে রাঁধুনিকে বোঝাতেন এই মেশিনে কিভাবে কফি বানাতে হবে। আর আমরা সেই জার্মান ও ভারতীয়, দুজনেরই অসহায় মুখ দেখে যারপরনাই আমোদিত হতাম।
নিরক্ষরেখার কাছকাছি যেসব দেশ, তাদের রান্নায় মশলার ভুমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একই রান্নায় একাধিক মশলা দেওয়ার প্রচলন – যেমন মাংসের ঝোলে আদা, পিয়াজ, রসুন, তেজপাতা, দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ। গন্ধর সঙ্গে সঙ্গে থাকে স্বাদ – ঝাল, মিষ্টি, টক, নুন, ঝাঁঝালো। এই সব থাকে মিশিয়ে। ফলে একই খাবারে নানারকম স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যায়। ইওরপিয়ান খাবারে একটি ধরনের স্বাদ ও গন্ধই সাধারনত প্রধান। ফলে একই খাবার বেশি খেতে একঘেয়ে লাগে। অল্প অল্প করে অনেক্ কিছু খেতে হয়। ৩-৪ প্রস্থের আগে তারা ক্ষান্ত দেন না। এক বাভারিয়ান রেস্টুরেন্ট -এ শুওরের ঠ্যাং খেতে গিয়ে আমার একবার ভারি বিপদ হয়েছিল। এতবড় ঠ্যাং, ঝাল মশলা ছাড়া, সেদ্ধ – বোধ হয় স্বয়ং ওবেলিক্স-এর ও অসাধ্য। আমি তো ছাপোষা বাঙালী।
ইওরপিয়ানরা খেতে বসেন সন্ধ্যা সাতটায় – খাবার পরে কফি ও পানীয় নিয়ে এঁটো হাতে বসে থাকেন প্রায় মাঝ্ রাত অবধি, সে ভারি মুশকিল। শুতে যাওয়ার আগে আবার ক্ষিদে পেয়ে যায়, এদিকে খাবার সময় ক্ষিদে পায় না।
তবে তারিফ করতে হয় রকমারি পাউরুটির – এতরকম যে মনেও থাকে না। তাতে কখনও রকমারি বীজ দেওয়া, কখনও তিল ছড়ানো। ছোট বড় বিশাল। ঘস ঘস করে করাতের মত এক ছুরি দিয়ে কাটতে হয়। এসব খুনোখুনি আমার ভাল লাগে না – আমি তখন উদাস হয়ে ফুলকো লুচির পেট ফুটো করলে কি’রকম ভুস করে গরম হাওয়া বেরিয়ে আসে, সেই কথা ভাবতে থাকি।
পাউরুটির দোসর ঠাণ্ডা মাংস। পরতে পরতে সালামি দিয়ে, চীজ মাখিয়ে। অবশ্য সসেজ বা বেকন পাওয়া যেতে পারে গরম। আর ইংল্যান্ডে ব্রেকফাস্ট হলে ব্লাডপুডিং – জমাট রক্ত দিয়ে পুডিং। এই জিনিসটি খেয়ে উঠতে পারিনি, এখনও। অস্ট্রিয়ায় সাহস করে, সবাই খাচ্ছে দেখে, গরুর আচার খেয়েছি – নুনে জারানো গরুর মাংস। যেমন শক্ত, তেমন নুন। কাঁচা তিমির মাংস নরওয়েতে -স্বাদহীন। আর এক বিপদ ভাতের বদলে আলু – সেদ্ধ, ভাজা, চটকানো, গোটা – স্বাদহীন খাবার খেতে খেতে কিছুদিন পরেই স্বাধীন দেশের চারটি ভাত-মাছের জন্য প্রাণ আনচান করে ওঠে।
ছবিঃ লেখক
Onek desh ghurechen apni lekhata besh interesting purotai porlam.besh laglo
LikeLike
Lekha ta khub bhalo laglo kintu title ektu anyo kichu holey aro khushi hotam.(obbosoi amaar byaktigoto motamot)
LikeLike
sesh er chobi ti ki sei seddho shuor er thang?..
apnar lekha guli khb bhalo lage.
prosenjit
LikeLike
Hyan 🙂
LikeLike