এ জায়গাটা প্রায় তিরিশ চল্লিশ বছর আগের সময়। মনে হয় যেন আমি টাইম ট্রাভেল করছি। ছোট্ট এয়ারপোর্ট। ঝকঝকে রাস্তা। গাছে গাছে ভরা শহর পোর্ট ব্লেয়ার। অমনি আমার ধোঁয়ায় মোড়া পানের পিকে ভরা কোলকাতা সামনে চলে এল, একই দেশ অথচ কত তফাৎ। আসলে আমার ভাঙাচোরা নোংরা শহরটাকে আমি বড্ড ভালোবাসি তাই যেখানে ভালো কিছু দেখি আমি মনে হয় আহা এটা যদি আমার শহরেও হত!
পোর্ট ব্লেয়ারে সব মেলানো মেশানো লোকজন। বাঙালি , তামিল, তেলুগু বাসিন্দা হিসেবে। আর ট্রাভেলার হিসেবে তো দেশের সব প্রদেশের লোকই। বিদেশিদের দেখা অবশ্য পাওয়া যায় না। তারা দ্বীপে ঘোরাঘুরি করে। হাসিখুশি ড্রাইভার ছেলেটা আমার বয়েসীই হবে , কিন্তু কী দারুণ গাড়ি চালায়! আমি আড় চোখে দেখেছি ক্লাচ ছাড়াই, ব্রেক কষে গাড়ি না থামিয়ে স্পিড কন্ট্রোল করছিলো। এহঃ আমি কবে পারবো এমন কে জানে।
যেই না সমুদ্রের ধরে এসেছি , আমি তো যাকে বলে বোব্বা। এ কী রকম কালার কম্বিনেশন রে বাবা! প্রথমে হালকা সবুজ, তারপর শিশিবোতলের মতো সবুজ তার পর কালি ডোবানো নীল। আরে আরে সামনের দিকের জল আবার এত পরিষ্কার সে জলের নিচে মাছ খেলে যাচ্ছে সেইটাও দেখা যাচ্ছে দিব্যি।
মাউন্ট হ্যারিয়েট যাওয়ার রাস্তায় একটা ঝিম ধরা জঙ্গল পড়ে। সুই টুই টুই করে একটা পাখি ডাকছে , জঙ্গলের নিস্তব্ধত বড় মায়াময়, দূরে রস আইল্যান্ডের লাইট হাউস , সাদা সি বিচ দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এখানে এই গাছের ছায়ায় যদি থেকে যাওয়া যেত!
ইন্টারনেট ছাড়া আট নয় দিন কাটানো সোজা কথা না এই বাজারে। তার মধ্যে আমার তো ফেসবুক চ্যাট এসব প্রায় নেশার পর্যায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু সবুজ গাছে মোড়া পাহাড় , নীল- সবুজ সমুদ্র , লাল নীল হলুদ মাছ, সাদায় কালোয় মেশানো কোরাল মুচকি হেসে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে, কী হে! দেখি কেমন পার আমাদের ছেড়ে ওই অন্যকিছুতে ডুব দিতে। ভাগ্যিস সে চ্যালেঞ্জ আমি জিতিনি।
আন্দামান তো অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপের সমষ্টি। তা তাই বলে তার উত্তর দক্ষিণ নেই তা তো না। সবুজ দ্বীপের রাজায় পড়েছিলাম মায়াবন্দর বলে একটা জায়গার নাম। মনে গেঁথে গিয়েছিল। কীরকম মায়াময় নাম। এক বন্ধুর থেকে একটু খোঁজ নিয়ে গিয়েছিলাম তাই যাবার আগে। অনেকে ওইদিকটা যায় না। জায়গাটা চমৎকার। বিরাট একটা বন পেরিয়ে, ভেসেলে করে খাঁড়ি পেরিয়ে যেতে হবে। ওই বনে আবার জারোয়াদের বাস, তাই পাহারা টাহারা দিয়ে নিয়ে যাবে, যাতে আমরা ওদের বিরক্ত করতে না পারি।
অবাক লাগে ভেবে মাঝে মাঝে, কষ্ট হয় , এতগুলো পূর্ণবয়স্ক লোক যাবে তাদের পাহারা দিতে হবে কেন? কেন একজন মানুষ চিড়িয়াখানা বা অভয়ারণ্যের জন্তু দেখতে যাওয়ার মতো আরেকজন মানুষকে দেখতে যাবার জন্য তার ছবি তোলার জন্য উত্তেজিত হবে। বুকের মধ্যে কষ্ট হচ্ছিলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসা জনজাতির জন্য। সব কিছু কেড়ে নিতে নিতে সামান্য এই জঙ্গলটুকুই তো ছিলো। আমরা নাকি সভ্য হয়েছি, অথচ অন্য মানুষকে সামান্য সম্মানটুকু করতে পারি না। আমাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যেতে হয় পাচ্ছে অসভ্যতা করি।
ভোর ভোর বেড়িয়েছি , সূর্য ওঠেনি এখনও, জঙ্গল ঘুমোচ্ছে। কুমার, মানে আমাদের গাড়ির চালক-এর চোখেও ঘুম লেগে। জঙ্গুলে নৈঃশব্দ বুনো গন্ধ সব কেমন বদলে যায় রাতে আর দিনে এই রাস্তা ধরে যেতে গিয়ে টের পেলাম। মানে এই যে এখন যাচ্ছি রাতের অন্ধকারে এখনকার হাওয়ার ঠান্ডা গন্ধটা অন্যরকম, পাতাদের শিরশিরে কথার আওয়াজ নেই। তারপর পারমিট নিয়ে যখন ব্যারাট্যাং এর পথে করেছি জারোয়াদের অঞ্চল দিয়ে তখন রোদ উঠেছে। হাওয়ায় ঠান্ডা আমেজ এখনো, তবে জঙ্গল জাগতে শুরু করেছে। নীল রঙের একটা পাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল দেখি। আরে ব্যাটার লেজটা দেখ যেন ড্রোন উড়ছে একটা। কতরকম গাছ কত পাখি ডাকছে। আমি চোখ থাকতেও অন্ধ হয়েছিলাম কিনা, তাই শিখিনি এতদিন কোনো গাছের নাম, কোনো পাখির নাম। ভারী আফশোস হচ্ছিল যে কী গাছ কী পাখি যদি জানতে পারতাম! ঠিক করেছি আমি ফিরে গিয়েই গাছ চিনব, পাখি চিনব। দূরে দেখি পরপর কয়েকটা গাছের পাতা এমন লাল রং ধরেছে মনে হচ্ছে লাল জঙ্গল। আরে আরে হলুদ পাখিটা(পরে জেনেছি ওটা আন্দামান বুলবুল) লাল গাছটায় বসে পুরো ইস্টবেঙ্গলের জার্সি বানিয়ে দিয়েছে তো। বাপরে বাপ্! কী করে লোকে পাখিদের ছবি তোলে কে জানে। আমি তো ক্যামেরা তাকে করলেই পাখিরা ফুড়ুৎ , মনে মনে নির্ঘাত জিভ ভ্যাঙায়।
ব্যারাট্যাং এ একটা চুণাপাথরের গুহা আছে। স্পিডবোটে করে দুই ধারের ঘন সবুজ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা খাড়ি পেরিয়ে পৌঁছনোটাই এত ভালো ছিল, পৌঁছে কী দেখব তার তাড়া আমার আর ছিল না। ছানা পাতাগুলোর সবুজ আর বড় পাতাগুলোর সবুজ দাঁড়িয়ে থেকে আলাদা শেড চিনিয়ে দিচ্ছে। আমাদের বোটের ছেলেটা ওস্তাদ বোটুরে(এরম শব্দ হয়ত হয় না , কিন্তু আমার মাথায় একে বোটুরে বলে ডাক এসেছে) , কাত করে দিচ্ছে এক একবার , জল এসে মুখে ছিটোচ্ছে আর এক এক করে বাকি বোটদের কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আকাশে তাকিয়ে দেখি একটা বড় কোন পাখি। চিল হতে পারে, বাজ হতে পারে। আমি জানি না। পরে খুঁজেও পাইনি।
স্পিডবোটটা গোঁত খেতে একটা সরু খাঁড়িতে ঢোকার পর ব্যাপারটা ছমছমে হয়ে গেল। এমনকি স্পিডবোটের গোঁ গোঁ আওয়াজ যেন সঙ্কুচিত। বাঘ নেই এখানে তবে কুমির আছে।
একবার একটা সিনেমা দেখেছিলাম। একদল লোক গেছে এক্সিপিডিশনে, গুহার মধ্যে অন্ধকারে চলতে চলতে তাছাড়া নানারকম বিপদের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তাদের মনোবল কমে আসে একসময়। তারপর অবশেষে একদিন সূর্যের আলোয় ফেরে দলের মাত্র দু’জন। কোনো গুহায় গেলেই আমার সেই সিনেমাটার কথা মনে পড়ে। খুব বড় না , বোরা গুহালুর তুলনায় একদম ছোট্ট কিন্তু তার মধ্যে প্রকৃতি চমৎকার হাতের কাজ দেখিয়েছে। কতকাল ধরে পাথরে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে, হাওয়া দিয়ে স্ট্যাল্যাকটাইট স্ট্যালাগমাইট এর নানা আকার তৈরি হয়েছে। লোকে তাতে গণেশ থেকে বুদ্ধ সব মূর্তি দেখছে। আমি একটু একপাশে সরে গিয়ে মোবাইল টর্চ জ্বেলে খুঁজতে চেষ্টা করছিলাম যদি আর কিছুর আকার খুঁজে পাই। বেশ একটা খেলার মত। আমি তিন চোখওয়ালা দৈত্য , ইউনিকর্ন, একটা হেলিকপ্টার এমনকি একটা স্পাইডারম্যান অব্দি খুঁজে পেয়েছি। যা খুঁজবে তাই পাবে।
দুপুরবেলার জঙ্গল ঝিম ধরানো। এই গভীর জঙ্গলে হিংস্র প্রাণী নেই কোন। পোষা হাতি, অল্প দু’একটা হরিণ, বুনো শুয়োর আছে কিছু। আর আছে ছোট ছোট গ্রাম। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো দু’তিন মাইল হেঁটে হেঁটে দিব্যি স্কুল চলেছে। এক মক্কেল দেখি লাফিয়ে লাফিয়ে একটা কাঠবেড়ালিকে ধাওয়া করেছে। তার দাদা হাঁক দিচ্ছে, স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে। চারিদিক ভারী শান্ত । যেন কোনো চিন্তা নেই , লড়াই নেই । বনের মধ্যে ছোট ছোট গ্রাম, পুলিশ চৌকি , স্কুল , বাড়ি । কোথাও বাহুল্য নেই । বরং এখানে যে চকমিলানো বাড়ি বা ঝকঝকে দোকানপাটই বেমানান। খাওয়ার দোকানগুলোও সব ভারী ছিমছাম , আর সবার মধ্যেই একটা আন্তরিকতার সুর ।
হ্যাভলক যাবার পথে উড়ুক্কু মাছ দেখলাম । আমি সিনেমা আর ন্যাট জিওর বাইরে আগে দেখিনি কখনও উড়ুক্কু মাছ । ফড়িংএর মতো , বা ক্ষুদে জেট প্লেনের মতো সাঁই সাঁই করে উড়ছে ব্যাটারা। দূরে দ্বীপগুলো কেমন রহস্যময় মনে হচ্ছে , রবিনসন ক্রুসোর মত আমি যদি ওরকম দ্বীপে গিয়ে পড়তাম!
আমাদের স্কুবা ডাইভ করতে নিয়ে যাবে যে ছেলেটা নাম লীলা। বোঝো! আমরা জানি লীলা মেয়েদের নাম হয়। ছেলেদের নামও হয় তা জানতাম না। দক্ষিণ ভারতীয় ছেলেটা খুব সুন্দর করে আমাদের সব বুঝিয়ে দিল। জলের নীচে কথা বলা যাবে না। সুবিধে অসুবিধে বোঝাতে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতে হয়। অল্প জলে বুঝিয়ে দেওয়ার পর ভাসাতে ভাসতে নিয়ে গিয়ে টুপ্ করে ডুবিয়ে দিল। আর ডুব দিতেই সে এক অপূর্ব পৃথিবী। ঝাঁক ঝাঁক নীল হলুদ , কালো লাল সব মাছ ঘুরছে। কোরালগুলো তো আমি ভেবেছি পাথর বুঝি । জ্যান্ত কোরাল কেউ কেউ আবার সরে সরে যাচ্ছিল আমাদের হাতের ছোঁয়ায়।
জলের নিচের ওই জগতে গিয়ে আমার ভারী সাধ হয়েছে ডুবুরি হবার। এখানে সমুদ্রের ধারে গাছপালা ভরা , নোংরা আবর্জনা ফেলে নষ্ট হয়ে যায়নি সি বিচ । এক সি বিচের ধারে বসে বসে সূর্যাস্ত দেখছি, নীল জলের পরে পাহাড় তার পিছন লাল টুকটুকে, হাঁসের ডিমের কুসুমের মত সূর্যটা অস্ত যাচ্ছে । তাকিয়ে থাকতে থাকতে বেভুল লাগে । তারপর টুকটুক করে এগিয়ে দেখি , দু ভাই বোনে চায়ের দোকান দিয়েছে। বোনের আবার দাদার উপর ভরসা কম। ঠিকমত গ্লাস ধুচ্ছে কিনা, চায়ে চিনির পরিমাণ ঠিক দিচ্ছে কিনা সে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কীরে স্কুল ফাঁকি দিয়ে এইসব হচ্ছে? অ্যাঁ?” মেয়েটা ছোট হলে কি হবে বেশি স্মার্ট । ফিক করে হেসে বলে, “দূর কিছুই জানো না তুমি। আমরা তো স্কুলের পরে এখানে এসেছি। আমাদের স্কুল ছুটি হয় তিনটের সময়।” বলে আবার খানিক ফিক ফিক হাসি । হাসছে কেন জানতে চাইলে সে কিছুই বলে না । খালি হাসে। জানা গেল তিনি এখন সিক্সে পড়েন। “দাদা কোন ক্লাসে পড়ে রে?”
ফিকফিক হাসি চেপে গম্ভীর স্বরে জানাল দাদা পড়ে না ।
“সে কী রে? তুই ব্যাটা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিস এক্ষুণি! অ্যাঁ?” বোনটি জবাব দিলেন তড়িঘড়ি, “দাদা নাইন অব্দি পড়েছে, আসলে এবার ক্লাসে উঠতে পারেনি তো তাই …”
ওদিকে দাদা তো চোখ বড় বড় করে বোনকে থামাতে চাইছে। শিগগির একটা যুদ্ধ লাগল বলে। আমি তাড়াতাড়ি দাদাকে বললাম, “আরে তাতে কী?, এক ক্লাসে বেশিদিন থাকলে স্কুল ছাড়তে হয় নাকি? পরের বার নতুন ক্লাসে না উঠলে তো নতুন গল্প হবে না।”
কী জানি কী ভাবল! আমায় বলল, “আমি স্কুবা শেখাব আর একটু বড় হলেই।”
ঝকঝকে স্বপ্নমাখা চোখজোড়াকে উৎসাহ দিয়ে বললাম, “বেশ বেশ। কিন্তু লেখাপড়াটা পাশাপাশি চালিয়ে গেলে আরো দূরের দূরের সমুদ্র নিয়ে জানতে পারবি তো রে ব্যাটা।”
লাজুক ছেলেটা নিজের স্বপ্নটুকু বলেই ভারী লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল, তাই ফের মাথা নামিয়ে ফেলল চটপট। আমি তার পিঠে চাপড় মেরে এগিয়ে গেলাম।
একটু পরে শুনি কিসের একটা হইচই। এগিয়ে গিয়ে দেখি, একজন ট্যুরিস্ট গাছের ডালে হোঁচট খেয়ে পড়েছে। আর এই ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে হাত ধরে টেনে তুলছে তাকে, বসাচ্ছে নিয়ে গিয়ে। ভাগ্যিস এ জঙ্গুলে জায়গায় আছে, অবারিত সমুদ্র আর গাছপালার ছায়ায় এখনো ভাগ্যিস ও তথাকথিত স্মার্ট হয়ে ওঠেনি। ভালো থাকিস , স্কুলে যাস বা না যাস এরকমই থাকিস, ভালো মানুষ হয়ে।
খুব ভাল লাগল। লেখা আর ছবি দুই-ই দুর্দান্ত।
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ । ছবিগুলো জয়ঢাকের সম্পাদকের 🙂
LikeLike
lekha aar chobi dutoi darun re!
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ । ছবিগুলো জয়ঢাকের সম্পাদকের 🙂
LikeLike
opurbo laglo
LikeLike