প্রথমে রাজমাতার খবর
গুজারাটের সৌরাষ্ট্র এলাকায় রয়েছে গির অরণ্য। সেইখানে পশুরাজ সিংহের বাস। সে ভারতের জাতীয় পশু না হতে পারে কিন্তু সে এলাকার লোকজন তাদের বেজায় ভালোবাসেন। এতটাই ভালোবাসেন যে তাদের সংখ্যা সে এলাকায় দ্রুত বাড়ছে। এমন কি তাঁদের দু একটা গরু ছাগল সিংহেরা খেয়ে নিলেও তাঁরা সেইটা বন্ধুকে নেমন্তন্ন খাইয়েছেন এইরকম চোখেই দেখেন।
সৌরাষ্ট্রের কাকরাচ এলাকার মানুষজনের এইরকমই প্রিয় একজন বন্ধু আছেন। তাঁকে সেখানকার লোকজন, এমনকি আমরেলি জেলাতেও লোকজন রাজমাতা নামেই চেনে। রাজমাতা এলাকায় টহল দিয়ে বেড়াতেন জঙ্গলের পথে লোকজন দেখলে কিছুই বলতেন না। এমনকি তাঁর অন্য কোন প্রজা মানে জঙ্গলের অন্য কোন জন্তু যদি তাঁর বন্ধু গ্রামের মানুষজনের গায়ে শিং, খুর বা থাবা দিতে আসত তাহলে সেই দুষ্টু প্রজাকে কড়া থাবায় শায়েস্তাও করতেন।
বনদফতর রাজমাতার গলায় রেডিও লাগানো মালা পরিয়ে দিয়েছিল। তাইতে তিনি কখন তাঁর রাজত্বের কোন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন সে খবর আসত বনের অফিসে।
২০১৩ সালের ঘটনা। হঠাৎ একদিন দেখা গেল রাজমাতা উধাও। রাজারাজড়ার ব্যাপার! হয়ত গোপন কোন কাজে গিয়েছেন কোথাও। এই ভেবে এলাকার লোক বিশেষ গা করে নি। বিশেষ করে গলায় যখন রেডিও কলার রয়েছে তখন বন দফতর নিশ্চয় জানে কোথায় আছেন তিনি। কদিন পরে বন দফতরের কাছে খবর করতে লোকজনের মাথায় হাত। রাজমাতার কলার থেকে কোন সংকেত আসছে না। তিনি সত্যিই হারিয়ে গেছেন।
খোঁজ খোঁজ খোঁজ। একটা পূর্ণবয়স্ক সিংহী! তাকে এইভাবে হারিয়ে যেতে দেয়া যায় না মোটেও। শেষমেস জঙ্গল তোলপাড় করে খুঁজে তাঁর দেখা মিলল অনেক দূরে, গোন্দাল নামে একটা জায়গায়।
বনদফতর তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে একটা চিড়িয়াখানায় আটকে রাখল। পশুরাজ হলে কী হয়, দেশের সরকারের কথা না শুনে নিজের এলাকা ছেড়ে উধাও হলে তার শাস্তি তাকে পেতেই হবে কি না!
কিন্তু তাদের রাজমাতার এমন অপমান সইতে রাজি নয় কাকরাচের লোকজন। জঙ্গলের পথে অবরেসবরে তাদের রক্ষা করেন তিনি। অরণ্যের শাসক তাদের রানিমাকে আটকে রাখবে সরকার, এ কেমন কথা।
অতএব তারা গিয়ে হামলা করে বসল বন দফতরের অফিসে। রাজমাতার মুক্তি চাই। বনদফতর বলল, “মোটেই না। রাজমাতা আইন ভেঙেছেন।”
তখন তারা ফিরে এল। বুঝল আইনের পথেই আইনের দেয়াল ভাঙতে হবে। চাষীরা বলল, তাদের ক্ষেতের ফসল যাতে হরিণেরা আর বুনোশুয়োরেরা খেয়ে না যায় তাইজন্য রাজমাতা তাদের ক্ষেত পাহারা দেন। ডেপুটি কনজার্ভেটর অংশুমান শর্মাও স্বীকার করলেন এই কথা। একদিন এলাকায় নজরদারি করবার সময় এক চাষীর ক্ষেতের ধারে তিনি রাজমাতাকে ঘুরতে দেখেছেন। চাষী মোটেই ভয় পায়নি। অংশুমানকে সে বলেহিল, “উনি রাজমাতা। আমাদের ক্ষেত রক্ষা করছেন। ওঁকে আপনি বিরক্ত করবেন না।”
সব খবরটবর শুনে কাকরাচের পঞ্চায়েত সমিতি বসল মিটিং করতে। তারপর সেইখানে পঞ্চায়েতের ভোটে জিতে আসা লোকেরা মিলে সিদ্ধান্ত নিল, রাজমাতাকে বন্দি করে রাখা হবে না আর। তাঁকে মুক্তি দিতেই হবে।
বনদফতরের লোকেরা যখন সেই চিঠি হাতে পেল তখন তারা আর কী করে! বেজার মুখে খুলে দিল বন্দিশালার তালা। তারপর গাড়িতে চাপিয়ে রাজমাতাকে সসম্মানে ফিরিয়ে দিয়ে গেল তাঁর রাজত্বে-গির অরণ্যে।
সেসিলের দুর্ভাগ্য
অবশ্য সবাই তো আর ভারতীয় নয় যে বনের পশুকে এমনভাবে ভালোবাসবে! তাই সব সিংহের কপালে এমন ভালো ব্যবহার জোটে না। যেমন ধরো জিম্বাবোয়ের হোয়াঞ্জে ন্যাশনাল পার্কের সেই অতিকায় সিংহরাজ সেসিল।
সারা দুনিয়া থেকে মানুষরা তাকে দেখতে আসত। সেসিল তাই মানুষদের বিশ্বাস করতে শিখেছিল। তাদের সে ভয় পেত না। জঙ্গল রক্ষকদের হাতের বন্দুকও সে দেখেছে। তাই বন্দুক হাতে মানুষকেও সে সন্দেহ করত না।
সেই সুযোগ নিল একটা আমেরিকান সাহেব। লোকটা দাঁতের ডাক্তার। সারা পৃথিবী জুড়ে জন্তুদের খুন করাটা তার হবি। তার আছে বন্দুক আর আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি সাংঘাতিক শক্তিশালী তিরধনুক। তাই দিয়ে সে ভালুক, গণ্ডার , সিংহ এমন অনেক জন্তুকে খুন করেছে। খুন করতে সে খুব গর্ব অনুভব করে। ভাবো দেখি এমন রাক্ষসদেরও জেলের বাইরে ছেড়ে রাখে যে দেশের সরকার, সেটা কেমন দেশ তাহলে!
যাই হোক খুনে বদমাশটা জিম্বাবোয়েতে গিয়ে পঞ্চাশ হাজার ডলার দিয়ে বনের জন্তুদের খুন করবার সুযোগ বানাল। তারপর টাকার জোরে খুন করবার অধিকার নিয়ে সে রাতের বেলা একটা মরা জন্তু গাড়ির সঙ্গে বেঁধে নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল।
আফ্রিকার এই গরিব দেশগুলোকে এইভাবে টাকা দিয়ে তাদের দেশের জন্তুদের খুন করতে ফি বছর সেখানে ইউরোপ আর আমেরিকার সাহেবগুলো বন্দুক নিয়ে এসে মৃত্যুখেলা খেলে। এই দেখ নামিবিয়ার একটা দোকানে সাহেবদের খুন করা জন্তুদের শুকিয়ে তাদের জন্য কেমন করে ট্রোফি বানানো হচ্ছে।
যাই হোক সেসিলের গল্পে ফিরে আসি। সেসিল খাবারের গন্ধ পেয়ে বেরিয়ে এসেছিল। কেন জানো? তার ঘরে আটটা ছোটোছোটো বাচ্চা। অনেক খাবার দরকার ছল তার। বন্ধুজীব মানুষ যখন সে খাবার নিয়ে তার রাজত্বে এসে ঢুকেছে তখন সে তাকে সন্দেহ করবে কী ভাবে। সেসিল যখন বিশ্বাসভরে গাড়িটার কাছে এগিয়ে এল , তখন ওয়াল্টার তাকে প্রথমে তিরধনুক দিয়ে আঘাত করল। ভীষণ চোট পেয়ে পালালো সেসিল। তারপর ওয়াল্টার নামের সেই সাহেব জন্তুটা চল্লিশ ঘন্টা ধরে তাকে তাড়া করে করে শেষে খুন করল, আর তারপর ইন্টারনেটে তার মৃতদেহের ছবিটাঙিয়ে খুব গর্ব করল।
আজ বিশ্ব সিংহ দিবসের সকালবেলা কমপিউটার খুলে বেজায় দুঃখ হল। কেন জানো? সেসিলের আটটা বাচ্চার একটাকে জঙ্গলের অন্য সিংহেরা মেরে ফেলেছে। আহা রে, তাদের বাঁচাবার জন্য যে ছিল, সে তো প্রাণ দিয়েছে একটা দোপেয়ে জন্তুর গুলিতে!
এসো আজ আমরা প্রতিজ্ঞা করি আমরা কেউ ইউরোপ আমেরিকার ওই খুনে সাহেবদের মত হব না। আমরা হব গুজরাটের সেই গ্রামের মানুষজনের মতন, যারা বনের পশুকে ভালোবেসে , সম্মান দিয়ে বন্ধু করে রাখে। তাদের লোভ দেখিয়ে টেনে এনে যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলে না।
Beautiful. Loved it. Rajmata & the men around her are loving @ protective. Basil is loving and sacrifices her life in the hands of a human looking beast.
LikeLike