আগের লোককথা-রমিত দে’র কলমে চাঁদের সিঁড়ি
শিলং শহর থেকে প্রায় আট-দশ মাইল পশ্চিমে রয়েছে একটি প্রসিদ্ধ পাহাড়। মেঘালয়ের খাসি জনজাতিদের লোককথাগুলিতে বিখ্যাত সেই পাহাড়টির নাম বার বার ফিরে আসে। পাহাড়টি “আইওই বৃক্ষের পর্বত” নামেই লোকমুখে পরিচিত। কালের প্রবাহে তার একসময়ের দুনিয়াজোড়া খ্যাতি এখন প্রায় হারিয়ে গেছে, তবু আজও জায়গাটার নৈসর্গিক রূপ-প্রাচুর্য সকলের মন কেড়ে নেয়। পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘ ভাসানো নীল আকাশের চাঁদোয়ার নীচে সেই টিয়া-সবুজ রঙ পাহাড়ের ঢালে সাজানো রয়েছে সমৃদ্ধ গ্রাম ও জুম চাষের ক্ষেত।
পাহাড়টির পাদদেশ দিয়ে সঙ্কীর্ণ আঁকাবাঁকা পথে বয়ে চলেছে উমিয়াম নদী। খাসি ভাষায় উমিয়াম নদীর অর্থ বিলাপকারী বা কাঁদুনে নদী। লোকে বলে, পাহাড় ও তার পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উর্বর জায়গা। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিল সুফলা চাষের জমি। কাছের ঘন বন-জঙ্গল থেকে আসত প্রচুর মূল্যবান কাঠ। এছাড়াও, অপূর্ব প্রাকৃ্তিক সৌন্দর্যের জন্য জায়গাটা ছিল বিখ্যাত।
শোনা যায়, সেই সবুজ বনের ভেতরকার ফাঁকা জায়গায় ঘুরে বেড়াত পরী-হুরির দল। সুগন্ধ ছড়ানো রঙিন ফুলের মাঝে বাসা বাঁধত বিচিত্র বর্ণের পাখিরা। প্রাচীনকালের সেই মানুষগুলির কাছে এমনটিই ছিল ‘আইওই বৃক্ষের পর্বত’।
সেই পাহাড়ের মাথায় গজিয়ে উঠেছিল এক অবিশ্বাস্য আয়তনের গাছ-আইওই গাছ-যা কিনা জঙ্গলের অন্যান্য বিশাল গাছগুলির মাথা ছাড়িয়ে সুদূর নীল আকাশকে ছুঁয়েছিল অনায়াস দক্ষতায়। প্রকৃ্তপক্ষে গাছটি ছিল এক অনন্য প্রজাতির উদ্ভিদ, যার প্রকৃ্তি মানুষের কাছে অজানা। চারপাশে বহুদূর ছড়িয়ে থাকা গাছটির মোটা-মোটা ডালপালা ছিল ঘন পাতায় ঢাকা। সেই ঘনপাতার বেড়াজাল ভেদ করে সূর্যরশ্মি এসে মাটিকে ছুঁতে পারত না।
বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়তে থাকা আইওই গাছের করাল ছায়ার নিচে শস্যশ্যামলা এই জায়গাটা একসময় হয়ে উঠেছিল ঊষর, অনুর্বর ও নিষ্ফলা।
এদিকে গাছটির খ্যাতি ক্রমশ নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বিভিন্ন দেশ থেকে হরেক জাতের মানুষ এসে গাছটি দেখবার জন্য ভিড় জমাল। তবে, গাছটির ডাল ভাঙবার বা বাকলে সামান্যতম আঁচর কাটবার সাহসও কিন্তু কেউ দেখাত না। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করত, গাছটিতে বসবাস করে কোন এক অজানা শক্তিশালী দেবতা, যাকে রুষ্ট করলে অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ ধ্বংসের কবলে পড়তেই হবে।
যুগের পর যুগ আইওই গাছটি ক্রমাগত বাড়তে লাগল, আর ততই বাড়োতে লাগল তার অমঙ্গলকারী ছায়া। সেই গাছের নীচে ছায়াঢাকা অনুর্বর-নিষ্ফলা জমির পরিমাণও তাই বেড়ে উঠল ক্রমাগত। মানুষ আর সেই পাহাড়ের ঢালে বসবাস করতে পারছিল না। চারপাশের বহু মাইল বিস্তৃত এলাকা জুড়ে চাষবাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। এককালের সমৃদ্ধ পরিবারের মানুষগুলি পলাতক আসামির মত সেই সদা-অনুসরণকারী অমঙ্গলের ছায়া থেকে পালিয়ে দিগ্বিদিকে বিদেশ বিভুঁইয়ে ঘরছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। যে পাহাড়ি বনপথ ও মনোরম বন ভরে থাকতো উল্লসিত কন্ঠস্বর ও শিশুদের সরল হাসির শব্দে, তা ক্রমশ পরিণত হল ড্রাগনের গোপন আস্তানায় কিংবা হিংস্র বন্য প্রাণীদের অবাধ বিচরণক্ষেত্রে। সেখানে সাধারণ মানুষেরা ঘোরাঘুরি করতে ভয় পেত।
ক্রমশ এই গাছের প্রভাবে গোটা বিশ্ব এক ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি হল। অবশেষে, আসন্ন সর্বনাশ থেকে বিশ্বকে বাঁচাবার তাগিদে সকল মানবজাতির এক দরবার আহ্বান করা হল, যাতে পরিস্থিতি বিবেচনা করে একটা উপযুক্ত সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়। দীর্ঘ, গুরুগম্ভীর আলোচনার পর স্থির হল, একদল সাহসী ও সুদক্ষ কাঠুরেকে পাহাড়টিতে পাঠানো হবে। তারা পাহাড় চূড়ায় পৌঁছে আইওই গাছটিকে কেটে ফেলবে। এতে সূর্যালোক আবার ফিরে আসবে পৃথিবীর মাটিতে।
তারপর সেই কাঠুরের দল যাত্রাপথের সব বিপদ-আপদ তুচ্ছ করে, তারপর গাছে অধিষ্ঠিত অজ্ঞাত দেবতার ক্রোধানলে ভস্ম হবার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে, গভীর অরণ্য ভেদ করে পাহাড় বেয়ে চূড়ার দিকে উঠতে উঠতে শেষমেশ আইওই গাছটির গোড়ায় পৌঁছোতে সক্ষম হল। একটুও সময় নষ্ট না করে, প্রবল পরিশ্রম ও দক্ষতার সাথে ধারালো কুঠার দিয়ে তারা গাছটি কাটবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল।
গাছটির বাকল ছিল ভীষণ কঠিন। দেখা গেল, রাতের অন্ধকার নেমে আসা পর্যন্ত তীব্র প্রচেষ্টা চালিয়েও কেবলমাত্র বাকলের সামান্য নীচ পর্যন্ত কাটতে তারা সক্ষম হয়েছে। গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করে, তারা পরস্পরকে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে গাছটির আশেপাশে তখনও পর্যন্ত সেই অজানা দেবতার ক্রোধের কোন লক্ষণ প্রকাশ পায়নি, আর সে-কারণেই হয়তো তাদের ওপর দুর্ভাগ্যের কালো ছায়াও নেমে আসেনি। মনকে এসব কথা বুঝিয়ে তারা সকলে বিশ্রাম নিতে গেল।
পরদিন সকালে খুব তাড়াতাড়ি তারা কাজের জায়গায় হাজির হল। কিন্তু ফিরে এসে তারা যা দেখল তাতে তারা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। দেখা গেল, আগের দিন প্রচন্ড পরিশ্রম করে গাছের যতটুকু তারা কাটতে পেরেছিল তার চিহ্ন একেবারে উধাও হয়েছে। আশ্চর্যভাবে গাছটির কান্ড আগে যেমনটি ছিল, ঠিক তেমনটিই হয়ে গেছে- যথেষ্ট কঠিন ও তাতে একটি আঁচড়েরও দাগ নেই!
কাঠুরেরা বড়ো কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল। তারা ফের গাছটির ধারে-কাছে ঘেঁষতে ভয় পেতে লাগল। তারা একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গেল, এলাকাটি ভূতগ্রস্ত। কিন্তু দলের মধ্যে কয়েকজন কাঠুরে ছিল সঙ্কল্পে অবিচল। ভীত সন্ত্রস্ত সাথীদের তারা স্মরণ করিয়ে দিল, মানবজাতি এক ভয়ানক বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে বাকিরা তাদের হারানো সাহস ফিরে পেল। সকল কাঠুরে আবার একজোট হয়ে গাছটি কাটবার জন্য জোর কদমে কাজে লেগে পড়ল। সারাদিন তারা কঠোর পরিশ্রম করলো, কিন্তু পরদিন সকালে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো! দেখা গেল, গাছটি আবারও কী এক আশ্চর্য জাদুবলে তার সব ক্ষত সারিয়ে ফেলেছে।
কাঠুরেরা কিন্তু গাছের ওপর হামলা চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, দিনের বেলা তারা যতই ধৈর্য সহকারে গাছটিকে কাটতো, রাতের বেলায় কী এক আজব উপায়ে গাছটি আবার আরোগ্য লাভ করতো। দিন-দিন কাঠুরের দল হতবুদ্ধি ও নিরুৎসাহ হয়ে পড়তে লাগলো। সেইসাথে, এমন অদ্ভুত একটি অঞ্চলে বসবাসের কষ্টগুলিও যেন ক্রমশ তাদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠছিল। শেষ পর্যন্ত তারা সেই ভৌতিক এলাকা থেকে পালিয়ে তাদের জ্ঞাতি-ভাইদের কাছে নিরাপদ স্থানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। নিত্যদিন এমন অতিপ্রাকৃ্তিক পরিস্থিতির মধ্যে থাকবার চাইতে ছায়াঢাকা বিশ্বের অনিবার্য পরিণতি সহ্য করাও যেন তাদের কাছে বেশি ভালো মনে হচ্ছিল।
কাঠুরেরা যখন এইসব কথাবার্তায় ব্যস্ত, ঠিক তখন একটি ধূসর রঙের ছোট্ট খাসিয়া টুনটুনি পাখি, কা ফ্রেইৎ, কিচিরমিচির করতে করতে তাদের পাশে এসে বসল। ধারে বসেই পাখিটি কাঠুরেদের সাথে কথা বলতে শুরু করল। সকলকে অবাক করে দিয়ে পাখিটি কাঠুরেদের বলল, সে তাদের সাহায্য করতে এসেছে। কাঠুরেদের সাহস বজায় রাখতে আহ্বান জানাল সে।
কা ফ্রেইতের এমনধারা কথা শুনে কাঠুরেরা নিস্তেজ অবস্থাতেও না হেসে থাকতে পারলো না। বনের সবচেয়ে ছোটো পাখিটা নাকি গাছ কাটতে সাহায্য করবে বিশ্বের সেরা বাছাই কাঠুরেদের!
কাঠুরেদের পরিহাস করতে দেখে টুনটুনি তাদের আরও কাছে এসে আগের চাইতেও উচ্চস্বরে কিচিরমিচির করতে লাগলো। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে সে কাঠুরেদের বলল, “এতে আমার কোন সন্দেহ নেই যে আপনারা মহান ও জ্ঞানী ব্যক্তি, আর সে কারণেই তো এমন একটি মহৎ কর্ম সম্পাদনের জন্য আপনাদের মনোনীত করা হয়েছে। তবে মনে রাখবেন, আপনারা কিন্তু সেই গুরুদায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ, আমি যখন আপনাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাইলাম,আপনারা আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠলেন। এ কথা সত্যি, আমি পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো, কিন্তু জঙ্গলের গোপন রহস্য জানার ব্যাপারে তা কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আইওই গাছটি সফলভাবে কাটতে হলে আপনাদেরও কিন্তু জঙ্গলের সেই গোপন রহস্যটি জেনে নিতে হবে।”
টুনটুনি পাখির মুখ থেকে এমন কথা শুনে কাঠুরেরা খুব অবাক হয়ে গেল। তারপর সবাই মিলে কা ফ্রেইৎকে অনুরোধ করল জঙ্গলের সেই গোপন রহস্যটি তাদের জানাবার জন্য।
শেষমেশ কাঠুরেদের ওপর খুশি হয়ে কা ফ্রেইৎ তাদের অবাক করে দিয়ে জানাল, গাছটির এমন রাতারাতি আরোগ্যলাভের পেছনে কোন অতিপ্রাকৃ্ত ক্ষমতার হাত নেই – যেমনটা কাঠুরেরা অনুমান করেছিল! আসলে এই অত্যাশ্চর্য ঘটনার পেছনে রয়েছে একটি বড় বাঘ- উ খ্ল্যা – যে কিনা প্রতি রাতে চুপচাপ এসে গাছের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলি চেটে দেয় আর এর ফলে সকাল হবার আগেই গাছটি আবার আগের মত অবস্থায় ফিরে যায়। প্রকান্ড গাছটির অন্ধকারাচ্ছন্ন ছায়াময়তার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শিকারের খোঁজে রোজ চুপিসারে ঘুরে বেড়ায় বাঘটি। তাই বাঘটি বেশ বুঝেছে, গাছটি কাটা পড়লে তার অশেষ ক্ষতির সম্ভাবনা। সে-কারণেই আইওই গাছটি কাটার সে ঘোর বিরোধী।
জঙ্গলের সেই গোপন রহস্য জানতে পারে কাঠুরের দল খুব উল্লসিত হয়ে উঠলো। উৎসাহিত হয়ে প্রবল উদ্দমে তারা গাছটির ওপর নতুন করে আক্রমণ হানতে শুরু করলো। ক্রমে রাতের অন্ধকার নেমে এল। এবার কিন্তু কাঠুরেরা অন্যদিনের মত তাদের কুঠারগুলি নিজেদের সাথে নিয়ে বিশ্রাম করতে গেল না। এর পরিবর্তে তারা অদ্ভূত একটি কান্ড করলো- তারা কুঠারের ধারালো প্রান্তটি বহির্মুখি করে গাছটির কান্ডে আটকে দিল।
সে রাতে বাঘটি আবার চুপিচুপি এল গাছের পাশে। এদিকে টুনটুনি পাখি যে কাঠুরেদের কাছে গোপন কথাটি ফাঁস করে দিয়েছে, তা কিন্তু বাঘটি একেবারেই জানে না। সে নিশ্চিন্ত মনে গাছের ক্ষত স্থান চাটতে লাগলো, কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে কুঠারের ধারালো ফলকে তার জিভ কেটে গেল। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত জিভ নিয়ে আতঙ্কিত অবস্থায় বাঘটি আর্তনাদ করতে করতে দূরে পালিয়ে গেল। কাঠুরেদের কাজে বিঘ্ন ঘটাতে বাঘটি কিন্তু আর সেখানে কখনও ফিরে আসেনি। এতে কাঠুরের দল নির্বিঘ্নে কাজ করবার সুযোগ পেল এবং সময়ের সাথে সফলভাবে আইওই গাছটি কেটে ফেলতে সক্ষম হল।
এভাবেই কা ফ্রেইৎ, ক্ষুদ্রতম এক পাখি, বিশ্বের মাটিতে পুনরায় সূর্যালোক ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে মানবজাতিকে সাহায্য করেছিল।
গল্পের উৎসঃ ‘The Legend of Iei Tree’ from “Folk-Tales of the Khasis” by Mrs. K.U.Rafy
ছবিঃ তন্ময় বিশ্বাস
জয়ঢাকের লোককথা লাইব্রেরি
বেশ লেখা
LikeLike