রাজীব কুমার সাহা র অন্যান্য লেখা
খুমপুই
রাজীবকুমার সাহা
জুমিয়া এক পরিবার। সার্দেংহা আর ডঙ্গরুংয়ের সংসার। সার্দেংহা অচাই (পুরোহিত), বেজায় বদরাগী মানুষ সে। সর্বক্ষণ পুজোআর্চা আর তন্ত্রমন্ত্র নিয়েই সময় কাটে; জুমচাষে তার মন নেই। চাষ করে তার দুই উপযুক্ত মেয়ে – রাইমা আর সাইমা। বড্ড ভাব দুটিতে। আর ঘর সামলায় তাদের আমা (মা) ডঙ্গরুং।
বোশেখ পড়ে গেছে। জুমে কাজের ভর মরসুম। সারাদিনের কাজের শেষে বাড়ি ফিরছে দু’বোন, রাইমা-সাইমা। মাথায় ও পিঠে খারাং (বাঁশবেতের তৈরি বড়ো ঝুড়ি বিশেষ) ঝুলিয়ে ক্লান্ত পায়ে তারা নেমে আসছে ছড়ার পাড় ধরে। সন্ধের মুখমুখ। আচমকা উত্তরের আকাশ বেয়ে ধেয়ে এল এক সাক্ষাৎ দুশমন – কালবৈশাখীর ঝড়। টং (ঘর) এখনও আধ মাইল দূর। সহসা এমনই কালো হয়ে উঠেছে চারদিক যে চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে শুরু হয়েছে বাতাসের তাণ্ডব। হঠাৎ পাশের ঝোপঝাড় মাড়িয়ে ধুপধাপ শব্দে কী যেন দৌড়ে গেল। বুক ধক ধক করে উঠল দুই বোনের। হাত জড়াজড়ি করে থমকে দাঁড়িয়ে রইল তারা। টিলার মাথায় মাথায় ছড়ানো-ছিটোনো জনপদ। দৌড়ে গিয়ে কাছাকাছি কারও টংঘরে আশ্রয় নেবে সে উপায়ও নেই। অন্ধকার নামলেই চারদিকে শ্বাপদের ভয় বেড়ে যায় কয়েকগুণ। মনে মনে তারা স্মরণ করতে লাগল বাবা গড়িয়াকে। সহসা পাশেই কোথায় যেন আকাশ কাঁপিয়ে বাজ পড়ল। দু’বোন লাফিয়ে উঠল। বিড়বিড় করতে লাগল জোড়হাতে, “বাবা গড়িয়া, রক্ষা করো আমাদের এ-যাত্রা।”
এদিকে ঝড়ের তেজ বেড়েই চলেছে উত্তরোত্তর। সোঁ সোঁ বাতাস। বনের গাছপালা, ঝোপঝাড় নুয়ে পড়ছে মাটিতে, আবার উঠছে। আজ বেঁচে ফেরার আর কোনও উপায় নেই।
একসময় শরীর মন এক করে বন্ধ চোখে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে রাইমা অস্ফুটে বলে, “হে বাবা গড়িয়া, কেউ যদি এক্ষুনি এখানে একটি ঘর বানিয়ে দেয়, তবে তাকেই আমি স্বামী হিসেবে বরণ করে নেব। আজ রাতটুকুর আশ্রয় চাই শুধু। প্রভু, এই আমি ছড়ার জল মা গঙ্গাকে সাক্ষী রেখে বলছি, প্রাণ থাকতে কোনও বাধাবিপত্তি আমাকে নিজের শপথ থেকে টলাতে পারবে না। আমি আমার শপথ রক্ষা করব, প্রভু। সদয় হও!”
কয়েক মুহূর্ত পরেই সাইমা কনুই দিয়ে ঠেলতে লাগল দিদিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় শব্দ বেরোচ্ছে না গলা দিয়ে। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলল রাইমাও। কোনোক্রমে একটা ঢোঁক গিলে সাইমা গোল্লা গোল্লা চোখে বলল, “বই (দিদি) দ্যাখ দ্যাখ, আমাদের জুমের দিকে একটা আলো দেখা যাচ্ছে না? ওই যে? কে এল সেখানে? আমাদের জুমে তো কোনও গাইরিং (অস্থায়ী টংঘর বিশেষ) নেই! এ-আলো তবে আসছে কোত্থেকে? শীগগির চল, ওখানে যাই।”
প্রাণের মায়া বড়ো বালাই। ভেবে দেখার সময় নেই। হাওয়ার ভর করে যেন সেদিকে উড়ে চলল দুই বোনে। অল্প খাড়াই পথ বেয়ে টিলার ওপরে উঠতেই দেখতে পেল, তাদের জুমেই খুব সুন্দর একটি বাঁশবেতের গাইরিং। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল দু’বোন। তাড়াহুড়ো করে ইকলাই (মাচায় ওঠার সিঁড়ি) বেয়ে ওপরে উঠতেই গা শিউরে উঠল এদের। দেখতে পেল, একটা বিশালকায় অজগর এঁকেবেঁকে বেরিয়ে আসছে গাইরিং থেকে। তারপর তাদের পাশ কাটিয়ে ইকলাই বেয়ে নেমে হারিয়ে গেল অন্ধকারে। রাইমা বুদ্ধিমতী। মনে মনে বলল, “হে গড়িয়া, মা গঙ্গার নামে শপথ করেছি প্রভু, আজ যিনি আমাদের এই আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেন, তাঁকে আমি অবশ্যই বিয়ে করব। সর্প হোক আর যাই হোক, কথার খেলাপ আমি করব না। জানি না প্রভু, আমার কপালের লিখন কী যে আছে।”
গাইরিংয়ের মাচাংয়ের (মাচা) একপাশে থাপায় (উনুন) ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। রাইমা-সাইমা বুঝতে পারে, এই থাপার আলোই তারা ছড়ার পাড় থেকে দেখতে পেয়েছে।
ঝড়বৃষ্টি অনেকটা ধরে এসেছে ততক্ষণে। দু’বোন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে, বেড়ায় বাঁধা বাঁশে থরে থরে সাজানো রয়েছে রিয়া ও পাছড়া, বিছানার চাদর। খুশি ছলকে ওঠে দুই বোনের চোখেমুখে। তাড়াতাড়ি ভেজা কাপড় পালটে নেয় তারা। শুধু তাই নয়, থাপার পাশে রয়েছে চাল, নুন, লঙ্কা, বাঁশকরুল আর নাপ্পিও (শুকনো মাছ)। মনের আনন্দে তারা রেঁধে-বেড়ে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল মাচাংয়ে চাদর বিছিয়ে।
ক্লান্তিতে আর বৃষ্টি ভিজে অচিরেই ঘুমে ঢলে পড়ার কথা ছিল এদের। কিন্তু কারও চোখেই ঘুম নেই। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। চারদিক থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক ক্রমশ ছেঁকে ধরছে যেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর সাইমাই প্রসঙ্গটা তুলল এবার। “বই, কী হবে রে এখন! তোকে যে শেষে সর্প বিয়ে করতে হবে, কথা দিয়েছিস।”
রাইমা একটুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “চিন্তা করিস না, বোন। সবই প্রভু গড়িয়ার ইচ্ছা। কথা যখন দিয়েছি, অন্যথা হবে না। ভগবান যখন চাইছেন তখন তাই হবে।”
সাইমার গলায় আতঙ্ক। বলে, “কী বলছিস, বই! এমনিতেই আফা (বাবা) সাংঘাতিক বদরাগী। তুই সাপ বিয়ে করেছিস টের পেলে কি আর রক্ষে থাকবে! কী না কী করে বসবে শেষে!”
রাইমা এর উত্তর দেয় না। সংকল্পের দৃঢ় বন্ধনে আটকা পড়েছে সে। শুধু মনে মনে বলে, ‘কী আর করবে। মেরেই তো ফেলবে বড়জোর। এমনিতে তো সন্তানের প্রতি কোনও দায়দায়িত্ব তার নেই। এই যে আজ এই ঝড়-তুফানে আমরা অমন ঘোর বিপদে পড়েছি, কই না তো, সে তো খুঁজতে এল না একবারও! দেখতেই এল না, মেয়েদুটো বেঁচে আছে কি মরে গেছে!’
শুয়ে শুয়ে এসব হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে চোখের কোল বেয়ে জল আসছিল দরদর করে তার। হঠাৎ হুঁশ ফিরতেই শ্বাসের শব্দে সে টের পেল, সাইমা ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে। থাপার মৃদু আলোয় বোনের মুখটা দেখে বড়ো অসহায় লাগল। বড্ড মায়া হল তার। সেও পাশ ফিরে বোনকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে শুয়ে রইল। কিন্তু ঘুম কি আর আসে? শুধু অদৃষ্টের কথা সাতপাঁচ ভেবে চলেছিল সে। ভাবতে ভাবতে কখন হয়তো চোখদুটো জুড়িয়ে এসেছে।
রাত আর বাকি নেই বিশেষ। একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল রাইমার। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। মাথার কাছে রাখা জলের ঘটি থেকে ঢক ঢক করে খানিক জল খেয়ে আবার চোখ বুজে পড়ে রইল সাইমার পাশে। মনে করার চেষ্টা করতেই আবছা থেকে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল স্বপ্নটা। সে দেখেছে, তাদের জুমে এক গাইরিংয়ের সাংসিতে (দাওয়া) ভোরবেলা বসে আছে সে। ফুরফুরে একটা হাওয়া দিচ্ছে থেকে থেকে। এমন সময় একটা বড়ো অজগর তার সামনে এসে হাজির হয়েছে। ভয়ে কাঁপতে লাগল সে। কিন্তু এ কী! অজগরটা সহসাই খুব সুন্দর একটা চিকলার (ছেলে) রূপ ধরে তাকে বলে, “আমাকে ভয় পেও না চিকলি (মেয়ে), আমি ইচ্ছাধারী নাগিন রাজপুত্র। আমি এই গাইরিং বানিয়ে তোমাদের চরম বিপদ থেকে রক্ষা করেছি। তুমি প্রতিজ্ঞা করেছ যে, তোমাদের এই ঘোর বিপদে যে ঘর তৈরি করে দিয়ে রক্ষা করবে তুমি তাকে বিয়ে করবে। তাই আমি এসেছি আজ তোমাকে বিয়ে করতে। তুমি এখন তোমার কথা রক্ষা করো, চিকলি।”
সে মুহূর্তেই ঘুম ভেঙে গেছে তার। রাইমা শুনেছে, ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। তবে কি আজ ভোরেই অজগরটা এসে তাকে বলবে তার শপথ রক্ষা করতে? তবে কি গত সন্ধের অজগরটাই কোনও ইচ্ছাধারী নাগিন রাজপুত্র!
এতক্ষণে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আর যতই সময় এগোচ্ছে ততই তার বুকটা ধকধক করে কাঁপছে। পরক্ষণেই ভাবল, শপথ যখন করেছি তবে ভয় পেয়ে কী হবে? তাঁকে তো আমার বিয়ে করতেই হবে।
সাইমারও ঘুম ভেঙে গেছে। দেখে, দিদি বসে আছে তার দিকে পিঠ দিয়ে। পাশ ফিরে দিদির কোমর জড়িয়ে ধরে বলে, “বই চল, এবারে ঘরে যাই।”
রাইমা শান্তস্বরে জবাব দেয়, “যাব রে, খানিকক্ষণ পরে। উঠে বোস একটু আমার কাছে।”
তারপর ভোরে দেখা স্বপ্নের সমস্ত কথা খুলে বলল বোনকে। সাইমা সব শুনে বলে, “ঠিক আছে বই, একটু পরেই যাব নয়। দেখি অজগর আসে কি না। যদি আসে তবে বুঝব তোর নিয়তিই তোকে তোর পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তুই তোর শপথ পালন কর বই, আফা-আমা না থাকলেও আমি সর্বদা তোর পাশে আছি জানবি।”
রাইমার বুকে চেপে থাকা পাথরটা নেমে গেল সহসা। সাইমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তবে তাই হোক। অজগর যদি আসে তবে আজই আমি ছড়ার জলে নেমে মা গঙ্গাকে সাক্ষী রেখে তাঁকে বিয়ে করব। আমার শপথ রক্ষা করব।”
এই যখন কথা হচ্ছে দু’বোনে, অচমকা পট পট করে কীসের শব্দ হল গাইরিংয়ের সাংসির ওপরে। উত্তেজনায় দু’বোন লাফিয়ে ওঠে সাংসির দিকে ঘুরে তাকিয়েই থম খেয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে রাইমা দেখল ভোরের স্বপ্নের রাজকুমারকে, তাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। অপার্থিব তার রূপ। কিন্তু সাইমা দেখল গতকালের ঝড়ঝঞ্ঝার সন্ধের সেই অজগরটাকে, যেটাকে এই গাইরিং থেকেই তারা বেরিয়ে যেতে দেখেছিল। সে দেখল, দরজার মুখে অজগরটা মাথা তুলে তাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
দিন যায়। দিনে দিনে শুধু রোগা হতে থাকে রাইমা। নিজের জন্য জুমে নিয়ে আসা দুপুরবেলার খাবার সে নিজে না খেয়ে অজগর বা দাঙ্গইকে (স্বামী) খেতে দিত। দাঙ্গইকে খাইয়েদাইয়ে অবশিষ্টটুকু সে আধপেটা খেয়ে থাকত। দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছিল সে তাই। বাবা সার্দেংহা ও মা ডঙ্গরুংয়ের মেয়ের এই শারীরিক অবনতি নজর এড়াল না। তারা এই নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে লাগল। মা ডঙ্গরুং একদিন রাইমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুই দিনে দিনে শুধু শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিস কেন, আমা? কী হয়েছে তোর, আমাকে বল তো খুলে।”
রাইমা নীরব থেকেছিল, কোনও উত্তর দেয়নি। ফলে রাইমাকে নজরে রাখছিল তারা। মনে অজানা এক সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল।
দাঙ্গই রাজা যে রাজপুত্র তা শুধু রাইমাই জানত। একমাত্র রাইমার চোখেই সে সর্বদা বরক (মানুষ) রূপে ধরা দিত। কিন্তু সাইমার চোখে সে ছিল শুধুই অজগর। সে যে এক ইচ্ছাধারী নাগিন রাজপুত্র, রাইমা একথা সাইমাকে বলেনি কোনোদিন। কারও কাছে একথা প্রকাশ করতে রাইমাকে বারণ করেছিল দাঙ্গই রাজা।
আশ্বিন মাস যায় যায়। টিলার সব বরকের টঙের বাংচাইয়ে (ধানের গোলা) ধান তোলার পর্ব শেষ। এদের একটা নিয়ম আছে। যে বরকের বাংচাইয়ে বছরে সকলের চেয়ে বেশি ধান উঠেছে তার বাড়িতে একদিন টিলার সব বরকের নিমন্ত্রণ। এ অনুষ্ঠানের নাম কামিমাইক্লন।
আজ সেই দিন। অনুষ্ঠানে রান্নার ডাক পড়েছে রাইমার। বউ-ঝিয়েরা নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠে সে অনুষ্ঠানে, রান্নাবাড়ায় হাত লাগায়, এগিয়ে পিছিয়ে দেয়। রাইমা গেছে সেখানে রাঁধতে। এই সুযোগে সাইমাকে বাড়িতে একা পেয়ে গেল অচাই সার্দেংহা। আর তাকে ফুসলিয়ে জানতে চাইল রাইমা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে কেন। সাইমা প্রথমটায় মুখ টিপে রইল; এড়িয়ে যেতে চাইল। কিন্তু শেষটায় জেরার মুখে বলে দিতে বাধ্য হল বাবার কাছে রাইমার সর্পবিবাহের কথা। মুহূর্তে পায়ের তলার মাটি সরে গেল অচাইয়ের। চোখমুখ হয়ে উঠল ইস্পাত-কঠিন। তার বড়ো মেয়ের এই সর্পবিবাহ কোনওমতেই মেনে নিতে পারল না সে। তবে সে বাইরে সাইমার চোখে তার এই অসন্তুষ্টি বুঝতে দিল না বিন্দুমাত্র। বরং আদর করে খুব ঠাণ্ডা মাথায় সাইমাকে বলল, “আমা, আমার চামরিকে (জামাই) দেখার খুব ইচ্ছে রে। রাইমাকে বললে সে রাজী হবে না জানি। তুই চল না আমা, রাইমা তো রান্নার কাজে ব্যস্ত, এই সুযোগে চামরি-বাবার সাথে দেখা করে আসি।”
এতক্ষণের দমচাপা এক আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেল সাইমা। সরল বিশ্বাসে পা দিল বাবার ফাঁদে। উৎসাহিত হয়ে বলল, “তাই চলো, আফা। বইও আমাকে কুমইয়ের (ভগ্নিপতি) দুপুরের খাবার পৌঁছে দিতে বলেছিল এক ফাঁকে। আজ সে তো ও-বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে না জুমে।”
বাবাকে নিয়ে সাইমা চলে গেল জুমে সেই গাইরিংয়ে। অচাই একটা ধারালো টাক্কল (দা বিশেষ) কোমরে গুঁজে নিয়ে গিয়েছিল। জুমে রওনা হলে সব বরকই এটা সঙ্গে রাখে। তাই এ নিয়ে সাইমার কোনও সন্দেহের কারণ ছিল না।
অচাই গাইরিংয়ে পৌঁছেই সাইমাকে তাড়া দিল, “কই, তোর কুমইকে খাওয়ার জন্যে ডাক দে, আমা।”
সাইমা ইকলাই বেয়ে নেমে দু’পা এগিয়ে যেতেই সার্দেংহা গাইরিংয়ে ঢুকে দরজার কাছে ওত পেতে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ইকলাইর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখা টাক্কল।
সাইমা ডাকল, “কুমই কুমই, মাইচানি ফায় (ভাত খেতে এস), তৈনুংনা ফায় (জল খেতে এস)।”
সাইমার এই আহ্লাদী ডাকে দাঙ্গই রাজা ছটফট করে উঠল। কিন্তু সে তার শ্বশুরের অভিসন্ধি টের পেয়ে নিজেকে সংযত রাখল। জুমের ধানগাছের গোছায় লেজ পেঁচিয়ে নিজেকে আটকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করল সে। আদরের শ্যালিকার ডাক সে কখনও উপেক্ষা করতে পারত না।
কিন্তু বারংবার সাইমার সেই ডাকে সে অস্থির হয়ে উঠল; আর টিকে থাকতে পারল না। লেজ ধানের গোছা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ইকলাই বেয়ে উঠে আসতে লাগল গাইরিংয়ে।
ইকলাই বেয়ে যেই জামাই মাথা তুলেছে সাংসিতে, অমনি অচাই ভেতর থেকে এক লাফে এসে টাক্কলের কোপে কোপে অজগরকে সাত টুকরো করে ফেলল। ঘটনাটা এতটাই আকস্মিক ঘটল যে সাইমার বাধা দেওয়ার কোনও অবকাশ রইল না। সে সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে গেল সাংসির ওপর।
অচাই করল কী, তড়িঘড়ি অজগরের দেহের টুকরোগুলো একটা পুঁটুলিতে বেঁধে নিল প্রথমে। তারপর জল ছিটিয়ে দিল সাইমার মাথায়, মুখে। সাইমার জ্ঞান হল ঠিকই, কিন্তু সাংসিতেই পড়ে রইল। অচাই পুঁটুলি হাতে চলে গেল প্রায় আধা মাইল দূরে এক চোরাবালিতে। পুঁতে দিল সেখানে। তারপর গাইরিংয়ে ফিরে এসে সাইমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে অনেক পীড়াপীড়ি করল। কিন্তু সাইমা কোনও সাড়া দিল না। শূন্যদৃষ্টিতে বসে রইল নির্বাক। অচাই ফিরে গেল একা।
ওদিকে কামিমাইক্লনের রান্না করতে করতে কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছে রাইমা। এতে নুন পড়ে না, তো ওতে লঙ্কা বেশি। থালাবাসন পড়ে যায় হাত থেকে। হাত-পা কেমন অবশ হয়ে আসছে। মন আর কিছুতেই রান্নায় আটকে রাখতে পারছে না সে। কেউ কথা কইতে এলেও বিষের মতো লাগছে। তার মন পড়ে আছে জুমের গাইরিংয়ে। কাউকে কিছু না জানিয়েই দৌড়ে এসে উঠল বাড়িতে। উঠোনে পা দিয়েই হাঁক পাড়ল, “সাইমা, ও সাইমা!”
কোনও সাড়া পেল না। তারপর এক মুহূর্ত ভেবে নিয়েই দৌড়তে লাগল চড়াই উতরাই বেয়ে ছড়ার তীর ধরে জুমের উদ্দেশে। খিল ধরে আসা পায়ে ছড়া পার করতে গিয়ে উলটে পড়ল জলে। ভিজে গেল সমস্ত শরীর। কোনওমতে টাল সামলে উঠে এল গাইরিংয়ে। দেখল, গাইরিংয়ের সাংসির ওপরে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সাইমা। ইকলাই আর সাংসির ওপর ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ। বুক কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়। বোনকে দু’হাত দিয়ে জোর ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে তোর বল! কখন এলি এখানে? তোর কুমইকে খাবার দিয়েছিস?”
তবুও সাইমা কথা কয় না। শেষে উপায়ান্তর না দেখে নিজেই স্বামীকে ডাকতে লাগল, “দাঙ্গই, দাঙ্গই, দা-ঙ্গ-ই…”
দাঙ্গইয়ের কোনও দেখা নেই। অঝোরে জল পড়ছে তার দু’চোখ বেয়ে। চিন্তা লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে।
রাইমার পেছন পেছন কখন তাদের সইটাটা (কুকুর) এসেও হাজির হয়েছে সে খেয়াল তার ছিল না। সইটা গাইরিংয়ে লাফিয়ে উঠেই আনাচে কানাচে শুধু গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছে কীসের। শেষে পায়ের কাছে এসে মাথা ঘষতেই হুঁশ হল রাইমার। কী একটা ইশারা করছে সইটা। গন্ধ শুঁকে শুঁকে এগিয়ে যেতে যেতে রাইমা-সাইমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছে ফিরে ফিরে। রাইমা-সাইমাও ছুটে চলল সইটার পেছন পেছন। শেষে একটা ছোটো ঝোরা পেরিয়ে জঙ্গলের প্রান্ত সীমায় গিয়ে থমকে দাঁড়ায় সইটা। আর পায়ে চলা পথের ধারে একটা নাবাল জলাভূমিকে বেড় দিয়ে ঘেউ ঘেউ করে মাটি শুঁকতে শুঁকতে ঘুরতে থাকে সে। রাইমা বুঝে যায়, এখানেই কাছেপিঠে কোথাও রয়েছে তার প্রাণপ্রিয় দাঙ্গই। দুই বোনে মিলে তাকে খুঁজতে খুঁজতে একটা ঝোপকে বাঁয়ে রেখে একটু সামনে এগিয়ে যেতেই দেখতে পায় একটা নদীর উৎসমুখ। অনেক উঁচু থেকে জল পাথরখণ্ডে লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে পড়ছে। জলের তীব্র আঘাতে সেখানে তৈরি হয়েছে এক গভীর কুণ্ড। আর কুণ্ডের চারপাশে ফুটে আছে সাতটা খুমপুই ফুলের ঝাড়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে তার মন মাতাল করা সুবাস। কুমই আর জীবিত নেই, সাইমা মুখ ফুটে বলে উঠতে পারেনি সেকথা দিদিকে। ক্লান্ত সাইমা বসে পড়ে খুমপুইয়ের এক ঝাড়ের পাশে। এক থোকা ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় গুঁজে দেয় বেখেয়ালে। আর রাইমা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করে, ফুলগুলো কেমন নেতিয়ে পড়েছে সঙ্গে সঙ্গেই। কী এক সন্দেহে ভুরু কুঁচকে ওঠে তার। এবার রাইমা সাইমার খোঁপা থেকে ফুলগুলো তুলে এনে নিজের খোঁপায় গুঁজে দেয়। আর আশ্চর্য, মুহূর্তে সতেজ হয়ে ওঠে ফুলগুলো ঠিক আগের মতোই! বুদ্ধিমতী রাইমার বুঝতে বাকি থাকে না যে এখানেই কোথাও রয়েছে তার দাঙ্গই।
তারা ফিরে আসে সেই চোরাবালির কাছে যেখানে স্থির হয়ে একটানা ডেকে চলেছে তাদের সইটাটা। সে একবার শুঁকতে শুঁকতে চলে যাচ্ছে চোরাবালির কাছে, পরমুহূর্তেই ঘেউ ঘেউ করতে করতে ফিরে আসছে রাইমার কাছে ফের। রাইমা আর স্থির থাকতে পারে না। উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে ওঠে, “দাঙ্গই, দাঙ্গই” বলে। মুহূর্তের ব্যবধান। সাইমা বাধা দেওয়ার আগেই সে উদ্ভ্রান্তের মতন হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে গিয়ে নামে চোরাবালিতে। দু’হাত দিয়ে কী যেন খুঁজতে থাকে এলোপাথাড়ি। খুঁজে খুঁজে তুলতে থাকে একটা একটা করে তার দাঙ্গইয়ের কাটা দেহের টুকরো। পাড়ে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সাইমা।
ওদিকে ওপাশের নদীর গর্ভকুণ্ডের জল ফুলে ফেঁপে উঠতে উঠতে রাইমার কাছে চলে আসতে থাকে। আর সাইমা দেখে তার প্রিয় কুমইয়ের দেহখণ্ড বুকে জড়িয়ে ধরে তার বই হারিয়ে যাচ্ছে জলের অতলে। তার বুক ফাটা কান্নায় বিদীর্ণ হয় আকাশ বাতাস। হেঁচকি তুলতে তুলতে কোনওমতে বলে, “বই বই, আমাকে এভাবে ফেলে রেখে কোথায় যাচ্ছিস তুই? কে দেখবে আমাকে?”
জলের নিচ থেকে উত্তর আসে, “আনি হানাউ (আমার আদরের বোন), তুই চিন্তা করিস না। ওই যে ওখানে ব্রুইফাং (বটগাছ) আছে, এতে উঠে তুই চরকায় কুতুং (সুতোর রিল) বানাস আর গান গেয়ে বলিস, আমাকে বিয়ে করলে রাজা পুত্রলাভ করবেন। এই পথে রাজা শিকারে যাবেন দিন কয়েকের মধ্যেই। তাঁর ছয় রানির কোনও সন্তান নেই। তোকে তিনি রাজরানি করবেন। কাঁদিস না বোন, আমি সর্বদা তোর পাশেই থাকব। ফের দেখা হবে আমাদের।”
সাইমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে রাইমার চুলের শেষ ডগাটাও তলিয়ে যায়।
সাইমা জানতেও পারে না, ওদিকে জলের অতলে ততক্ষণে খুমপুইয়ের মালা হাতে রাইমার সামনে এসে প্রকট হয়েছে অজগররূপী দাঙ্গই রাজা। সার্দেংহার হাতে চিরতরে সাপের খোলস ছেড়ে সে অপরূপ এক রাজপুত্রের শরীরে ফিরে গেছে। পেছনে দাঁড়িয়ে তার সুরম্য বিশাল রাজপ্রাসাদ। নতুন পাটরানির অপেক্ষায়।
(ত্রিপুরদেশের লোককাহিনি)
জয়ঢাকের সমস্ত লোককথা একত্রে এই লিংকে
darun
LikeLike