লোককথা
আজ তোমাদের গল্প বলার আগে ‘আচিক’ শব্দটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। আমাদের উত্তর পূর্বে যে মেঘালয় রাজ্য সেখানে গারোপাহাড়ে যে উপজাতিরা বহু বছর ধরে বাস করছে তাদের গারো জনজাতি বলে, কিন্তু এই গারো নামটা নাকি বিজাতীয়দের দেওয়া বলে মনে করেন অনেকে। তারও একটা ইতিহাস আছে, তবে ইতিহাস না বলে তাকে লোকমুখে প্রচলিত মিথ বলা যেতে পারে। এই উপমহাদেশে নাকি একসময় বিশাল এক পাখি বাস করতো,যার নাম ছিল গ্যারোপাখি আর সে সব গৃহপালিত ছোটোছোটো পশুপাখি ধরে খেয়ে নিত যার ফলে সব লোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, ঠিক এমন সময়ই নাকি সেই বিশালাকায় পাখি এক গারো বীরযোদ্ধা বাবা আর ছেলের হাতে শেষমেশ শিকার হয় যার থেকে গ্যারোপাখির নামের সাথে মিল রেখে বিজাতীয় লোকেরা গারো বলে তাদের সম্বোধন করতে শুরু করে। কিন্তু অনেক গারোই নিজেদেরকে ‘আচিক’ , বা ‘মান্দি’ বলতে বেশি পছন্দ করে। ‘মান্দি’ মানে মানুষ আর ‘আচিক’ শব্দের অর্থ পাহাড়,এই ‘আচিক’ গারো জনজাতির প্রধান উপভাষা, বলতে পারো আমাদের মাতৃভাষা যেমন বাংলা তেমনি মেঘালয়ের ওই গারোপাহাড়ের পাদদেশে বাস করা গারোদের মাতৃভাষা ‘আচিক’ আর গারোদের প্রথা বিশ্বাস কল্পকাহিনী কিংবা রূপকথা –সংস্কৃতির সবটুকুই যে পাহাড়কে নিয়ে তাই তারা নিজেদেরকে ‘আচিক’ বা পাহাড়িয়া বলতে পছন্দ করে খুব।
তা এই ‘আচিক’দেরই একটা গল্প তোমাদের আজ বলি। অনেকদিন আগে গারো পাহাড়ের নিচে পাহাড়ের পবিত্র সুগন্ধ আর গাছেদের আদরে গড়ে ওঠা আচিকদের গ্রামে জাজং বলে একজন লোক বাস করত ,থাকার মধ্যে তার ছিল খুব সুন্দরী বউ আর ফুটফুটে ছেলে একটা। বউ আর ছেলে অন্তপ্রাণ ছিল জাজং,তাদের জন্য কি না করত! নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েও যেন ছেলে বউকে সুখী রাখা চাই এই ছিল জাজংয়ের সর্বক্ষণের চিন্তা। তা একদিন সন্ধের সময় স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে খোলা জানলার ধারে বসে বসে গল্প করছে জাজং , থালার মত চাঁদ উঠেছে নীল আকাশে,টলটল করছে তার সোনার মত মুখ; তার সব রূপ সব ঐশ্বর্য সব গৌরব নিয়ে চাঁদ যেন আজ মেতেছে জাজংদের পুরো পরিবারটাকে মুগ্ধ করতে,আর জাজং’র ছোট্টো ছেলে ওমন থালার মত চাঁদ দেখেই কাঁদতে জুড়ে দিল, বাবার কাছে তার একটাই বায়না – ওই চাঁদ তার চাই-ই-চাই।
বাবা তাকে যত বোঝায় ,দেখ, এমন তো শক্তপোক্ত কোন রাস্তা তৈরি হয়নি চাঁদ অবধি পৌঁছোবার , হলে না হয় তোমায় ধরে এনে দিতাম। কিন্তু কে কাকে বোঝায়, যতই জাজং তার ছেলেকে ইনিয়েবিনিয়ে মানাবার চেষ্টা করে তত তার কান্না যায় দ্বিগুন বেড়ে। আসলে বাবা মায়ের আদরে প্রশ্রয়ে জাজংয়ের ছেলে আস্ত একটা বখাটে হয়ে উঠছিল। কান্না তার থামেই না আর শেষমেশ সে চাঁদ ধরে দেওয়ার বায়না নিয়ে নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দিল।
দিন যায়, মাস যায়, আর রোগা শীর্ণ, দুর্বল হতে থাকে জাজংয়ের ছেলে। মা তো ছেলের এই দশা চোখে নিতে পারে না। একবার ছেলেকে বোঝায় তো একবার জাজংকে। শেষমেশ জাজংকে তার বউ ধাতানি দিয়ে বলে ওঠে , ‘কী চাও তুমি? ছেলেটা বেঘোরে না খেয়ে না শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে প্রাণ দিক? আমার বিশ্বাস তুমি চাইলেই চাঁদ অবধি একটা রাস্তা নিশ্চয় বানাতে পার , আর রাস্তা না হোক একটা সিঁড়ি তো বানানোই যায় তাই না? যাতে চাঁদ আমাদের সবার হাতের মুঠোয় চলে আসে!”
বোকা বউ জাজংয়ের, সে নিজেও জানে এ কাজ সম্ভব নয় তবু তার স্বামীকে বারবার তাগাদা দিতে থাকে চাঁদ অবধি যাওয়ার সিঁড়ি একটা বানিয়ে দেওয়ার জন্য আর শেষমেশ একমাত্র ছেলের কান্না আর বউয়ের আবদারের কাছে হার মেনে জাজং ছেলেকে প্রতিশ্রুতি দিল চাঁদের সিঁড়ি সে বানিয়ে দেবে আর চাঁদকেও সে ধরে আনবে ছেলের জন্য। হাজার হোক তার একটাই ছেলে আর আবার একটাই বায়না সে ছেলের।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পাহাড়ের তলার ঘন জঙ্গল থেকে প্রচুর লম্বা কাঠ বাঁশ যোগাড় করতে থাকল জাজং আর সে’সব উঠোনের এক কোণায় জড়ো করতে লাগল। দেখতে দেখতে স্তূপীকৃত হয়ে উঠল কাঠ বাঁশের যাবতীয় সংগ্রহ। এ কাজে জাজং তার ভাগ্নেকে সাথে নিল। ভাগ্নের কাজ বলতে উঠোনের স্তূপাকার বাঁশ থেকে একটা একটা করে লম্বা বাঁশ বের করে মামা জাজংকে এগিয়ে দেওয়া যাতে সে একটার পর একটা বাঁশ কাঠ সাজিয়ে সিঁড়ি বানাতে পারে। এমনিভাবে একটু একটু করে ছেলের জন্য চাঁদে পৌঁছোবার সিঁড়ি বানাতে লাগল জাজং আর সে সিঁড়ি যখন মেঘকেও ছাড়িয়ে গেল জাজংয়ের মনে হতে লাগল সে বুঝি ওই চাঁদের কাছাকাছি এসে পড়েছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ভাগ্নের উদ্দেশ্যে জাজং বলতে লাগল, ‘কাঠ দাও, কাঠ, আরও কাঠ দাও।’
কিন্তু জাজং তো অনেক দূরে সেই মেঘের দেশ ছাড়িয়ে। তাই তার গলার শব্দ ভেসে আসতে আসতে ক্ষীণ হয়ে গেল আর যা এসে পৌঁছোল তার ভাগ্নের কানে তাতে খানিকটা মনে হল জাজং যেন বলছে-‘চাঁদ নাও চাঁদ, চাঁদ পেয়ে গেছি। এবার সিঁড়ি ভেঙে আমায় নামাও।”
প্রথম প্রথম জাজংয়ের ভাগ্নে তো নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছিল না আনন্দের চোটে। তারপর সে আরও ভালো করে কান পেতে শুনতে লাগল এবং আবার একই সুর ভেসে এল মেঘের ওপার থেকে-‘চাঁদ পেয়ে গেছি,এবার সিঁড়ি ভেঙে আমায় নামাও।’
এত বড়ো সিঁড়ি; তাকে নামানো তো চাট্টিখানি কথা নয়। ভাগ্নে তাই দিল কুড়ুলের এক কোপ একেবারে সিঁড়ির নিচের বাঁশগুলোয়। ওমনি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল সিঁড়ি, সিঁড়ির মাথা থেকে কোথায় যে ছিটকে পড়ল জাজং তা কে জানে। জাজংয়ের দেহের একটুকরোও খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও।
দিন যায় মাস যায়। জাজংয়ের বউ, ভাগ্নে , ছেলে অপেক্ষা করে কবে সে আসবে সিঁড়ি থেকে নেমে! কিন্তু সিঁড়িই যে নেই তা কে বোঝাবে অবুঝ ওই মানুষগুলোকে! শেষমেশ অনেক মাসের পর যখন জাজংয়ের ফিরে আসার আর কোনো লক্ষণই দেখা গেল না তখন জাজংয়ের বউ আর ভাগ্নে আশা ছেড়ে দিয়ে শেষ সিদ্ধান্তে এল নিশ্চয় চাঁদ পেয়ে আনন্দে লোভে আরো অনেক উপরে তারাদের দেশে পাড়ি দিয়েছে জাজং । রাগে কিটমিট করল বউ। ভাগ্নে আর ছেলেও জাজংয়ের ওপর অভিমান করে মনে মনে ফোঁসফোঁস করল। কিন্তু সে’সব করেও জাজং ফিরবে না জেনে তারা মনের দুঃখে বাড়ি ফিরে এল।
ওদিকে, সেই যে কুড়ুলের কোপে সিঁড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল তাতে তো কত কত কাঠ বাঁশ হুড়মুড় করে নিচে নেমে এল! স্তূপাকার হয়ে পড়ে রইল সিঁড়ির সে’সব ভাঙা অংশ। অনেক অনেকদিন ধরে সেইসব স্তূপ বেড়ে উঠে উঠে একদিন পাহাড়ে বদলে গেল আর সে পাহাড়ের নাম হল জাজং কাদোরাম;
এবার ছুটিতে বাবা মায়ের হাত ধরে একবারটি বেড়িয়েই এসো না আমাদের উত্তর পূর্বের ছোট্ট মেঘালয়ে! দেখবে গারো মানুষদের ছোটো ছোটো বাড়িগুলোর মাথার ওপর কেমন ভায়োলেট ফুলের দল আর হাসিখুশি উচ্ছল পাখিদের বুকে নিয়ে সে পাহাড় এখনও দাঁড়িয়ে। কাছে গেলে মনে হবে পাহাড়টাও হাসছে তোমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে; কে জানে, হয়ত জাজংই চাঁদ নিয়ে বসে আছে ঐ পাহাড়ের মাথায় আর আমাদের দিকে চাঁদের আলো ছুঁড়ে দিচ্ছে। চাঁদের সিঁড়ি বাড়িয়ে দিয়ে বলছে এসো , এসো …
ছবিঃ মৌসুমী