তরুণকুমার সরখেল-এর অন্যান্য লেখা
তরুণকুমার সরখেল
ভুকলা সেই কাকভোরে উঠে মাঠে গিয়ে লাঙল চালায়। লাঙলের পাকে ঘুরতে ঘুরতে তার খুব খিদে পায়। বলদ দুটোও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ভুকলা তখন তাদের জিরেন দেয়। বলদ দুটো মাঠে গিয়ে ঘাস খেতে থাকে। আর ভুকলা খেতের আলে বলে তার বউয়ের জন অপেক্ষা করে। কখন তার বউ একথালা পান্তা ভাত আর কাঁচালঙ্কা নিয়ে মাঠে আসবে। বউ পান্তা ভাত নিয়ে এলে ভুকলা নুন মেখে ঝটপট করে পান্তা খেয়ে নেয়। তারপর আবার কাজ শুরু করে। তার বউ চেপি ঘরে ফিরে আসে।
একদিন হয়েছে কী, চেপি ভুকলার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে এমন সময় একটা ভুঁড়ো শেয়াল তার পথ আগলে দাঁড়াল। বউ ভুঁড়ো শেয়াল দেখে তো ভয়েই অস্থির।
শেয়াল তাকে বলল, “ভয়ের কিছু নেই ! গামছায় বাঁধা পান্তা আর নুন তাড়াতাড়ি মাটিতে নাময়ি রাখ। আগে আমি পেট ভরাই তবে তোকে ছাড়বো। আর পান্তা না পেলে আমরা শেয়ালের সাঙ্গোপাঙ্গোরা সবাই মিলে ভুকলাকে মেরে ফেলব।”
চেপি কী আর করে। সে তো ভয়েই অস্থির। তাই তাড়াতাড়ি গামছা খুলে পান্তা মাটিতে নামিয়ে দিল।
শেয়াল বলল, “এবার আয়েস করে নুন মেখে পান্তা খাই। ততক্ষণে তুই আমার লেজটা সোজা করে ধরে রাখ।”
সেই মত চেপি ভুঁড়ো শেয়ালের লেজটা সোজা করে ধরে রাখল। তারপর শেয়ালের অর্ধেক পান্তা খাওয়া হয়ে গেলে এঁটো খাবারটা ভুকলার কাছে নিয়ে এল। ভুকলা ভাবে তার বউ তার জন্য নুন-পান্তা একসঙ্গে মেখেই এনেছে। কিন্তু এইটুকু খাবারে তার পেট ভরে না। তবে সে মুখে কিছু বলে না। বউটার আর কী দোষ। ঘরে যা থাকবে তাই তো সে নিয়ে আসবে।
শেয়াল তো নুন-পান্তা খেয়ে বেশ মজা পেয়ে গেছে। সে রোজই চেপির পথ আগলে দাঁড়ায় আর বলে, “পান্তা না পেলে তোদের সব ফসল নষ্ট করে দেব। ভুকলাকেও সবাই মিলে কামড়ে দেব।।” এই কথা শুনে চেপি ভয় পেয়ে গামছা খুলে নুন আর পান্তা শেয়ালকে নামিয়ে দেয়। তারপর শেয়ালের লেজটা লম্বা করে ধরে রাখে। শেয়াল মহানন্দে পান্তা খায়। অর্ধেক খাওয়া হয়ে গেলে তবে সে ওঠে। এরকম রোজই চলতে থাকে। বেচারা ভুকলা মাঠে খেটে খেটে আর আধ-পেটা ভাত খেয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে।
ভুকলার মা একদিন বলল, “বাছা তোর কি পেট ভরে না ? দিন দিন তুই দড়ির মতো হয়ে যাচ্ছিস।”
ভুকলা বলল, “সেই ভোরবেলা থেকে লাঙল চালাতে চালাতে খুব খিদে পেয়ে যায়। অর্ধেক থালা পান্তায় কি পেট ভরে?”
একথা শুনে তার মা তো বেশ চিন্তা পড়ে গেল। সে তো নিজের হাতে ছেলের জন্য রোজ থালা ভর্তি করে পান্তা গামছায় বেঁধে দেয়। সঙ্গে নুন আর কাঁচালঙ্কাও দেয়। তাহলে ? চেপিই কি অর্ধেক ভাত খেয়ে এঁটো ভাত তার স্বামীকে খেতে দেয় ? ছিঃ ছিঃ। তখনই চেপির ডাক পড়ল।
চেপি এবার সব কথা খুলে বলল, “মাঠে যাবার পথে একটা ভুঁড়ো শেয়াল রোজ আমার পথ আগলে দাঁড়া। তারপর বলে অর্ধেকটা পান্তা তাকে না দিলে সে আমাদের ফসল নষ্ট করে দেবে। আপনার ছেলেরও ক্ষতি করে দেবে। সেই ভয়েই আমি তার লেজটা ধরে টান দিই আর শেয়ালটা অর্ধেক পান্তা খেয়ে তবে আমাকে যেতে দেয়।”
ভুকলার মা এবার সব বুঝতে পারল। এই কারণেই তার ছেলেটা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। ভুঁড়ো শেয়ালকে কীভাবে জব্দ করবে সেটা বউমাকে শিখিয়ে দিল।
পরের দিন ঠিক সময়েই ভুঁড়োটা পথ আগলে দাঁড়াল আর বলল,
“ধর দেখি লেজ টেনেটুনে
খাই নুন-ভাত শাইন্যে-শুন্যে (মাখামাখি করে)।”
চেপি তৈরি হয়েই ছিল। শেয়ালটাকে ভাত দিয়ে এক হাত দিয়ে তার লেজটা টেনে ধরল। তারপর কোমর থেকে একটা কাস্তে বের করে খ্যাচ করে শেয়ালের লেজটা কেটে ফেলল। শেয়াল তো তখন “বাবা-রে – মা রে” বলে লাফাচ্ছে। লেজ হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে একটা গর্তে ঢুকে পড়ল আর বের হল না। চেপি ভাবল, “যাক্ বাঁচা গেল। ভিটরেটা আর জ্বালাতে আসবে না।”
কিন্তু পরের দিন ভুকলা মাঠে গিয়ে দেখে তাদের খেতের সব লাগানো ফসলের চারা নষ্ট হয়ে গেছে। কে এটা করেছে তা ভুকলার বুঝতে বাকি থাকল না। ভুঁড়ো শেয়ালটা লেজ হারিয়ে এভাবেই প্রতিশোধ নিয়েছে।
ঘরে ফিরে সবাই মিলে আলোচনায় বসল। ভুঁড়োটাকে তো জব্দ করতেই হবে। তা না হলে রোজ রোজ সেটা ফসলের ক্ষতি করে যাবে। সবাই মিলে তারা একটা ফন্দি আঁটলো।
দু-তিন পর ভুকলার মা মাঠে গিয়ে শেয়ালের গর্ত দেখে বসে পড়ল। তারপর বেশ ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে শুরু করল,
“ওরে ভুকলার বাপ কোথায় গেলি ই ই ই ই রে…..।”
তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে লেজকাটা শেয়ালটা গর্ত থেকে বের হয়ে এল। বলল, “বুড়িমা কাঁদিসে কেন? ভুকলার বাপ কোথায় গেছে ?”
ভুকলার মা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “সেই কথাটা জানাতেই তো এসেছি রে। ভুকলার বাপ আর বেঁচে নেই। কালকেই যে তার ছেরাদ্দ। তোরা সব আমাদের বাড়িতে খেতে যাবি। তোদের নেমন্তন্ন করতে এলাম।”
লেজকাটা বুড়িমাকে শান্তনা দিয়ে বলল, “নিশ্চয়ই যাবো। সবাই মিলে দল বেঁধে যাবো। কোন চিন্তা নেই।”
পরের দিন শেয়ালের দল ভিটরেটার সাথে এসে হাজির। ভুকলার মা শেয়ালগুলোকে একটা লম্বা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। আর বলল, “তোদের আজ সারাদিন ধরে ভালমন্দ খাওয়াবো। তোরা যাতে পালাতে না পারিস তাই তোদের বেঁধে রাখলাম।”
এই বলে সে ডাক পাড়ল, “আয় তো বাপ ভুকলারে, শিঁয়াকূলের চাবুকের খেলা দেখারে।”
শেয়ালেরা ভাবল এবার বোধ হয় তাদের জন্য ভালমন্দ খাবার আসবে। কিন্তু তার বদলে ভুকলা আর তার বাপ একটা করে শিঁয়াকুলের চাবুক নিয়ে এসে শেয়ালগুলোকে সপাৎ সপাৎ করে মারতে লাগল। আর সেই মারের চোটে তারা দড়ি গলায় নিয়েই দে ছুট।
ছুটতে ছুটতে একেবারে মাঠের শেষে এসে হাজির। তারপর সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে এক একটা গর্তে ঢুকে পড়ল। আর বের হল না।
–মানভূমের প্রচলিত লোককথা।
জয়ঢাকের সমস্ত লোককথা একত্রে এই লিংকে