“অন্যরকমের গল্প”
ছবির নাম- “দ্য ব্রেডউইনার”
আলোচক রুমেলা দাস
গল্পটা একটু অন্যরকমের। গল্পটা পারভানার। গল্পটা ওর পরিবারের। মা, বাবা, ভাই, দিদি আর গোটা ৯৪মিনিট ধরে ওর ছোটার গল্প! তোমরা ভাবছো এ ছোটা কেমন? পারভানা কি উসেইন বোল্ট হয়ে গেছে? না, ঠিক তা নয়! কখনো ভয় পাওয়া, কখনো মনের অদম্য জেদ জড়ো করে, নিরন্তর ছুটে যাওয়া এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। দুর্বল ভাবনাদের সরিয়ে, একমুঠো সাহস-ই গল্পের আপাদমস্তক। ফ্যান্টাসি আছে, দেবদূত নেই! পারভানাকে দেখতে দেখতে আমি, আমরা কখন যে ছোটদের মাঝে ফিরে যাই, কখন আবার প্রতিকূল ঠেলে মাথা তুলে দাঁড়াই তা বুঝতেই পারিনা। এই উঁচু নিচু চলার গ্রাফেই, চোখ বুলিয়ে নিই কি আছে পারভানার গল্পে, ওদের গল্পে!
সিনেমার নাম “দ্য ব্রেডউইনার”. কানাডিয়ান লেখক ডেবোরা এলিস (Deborah Ellis) এর “দ্য ব্রেডউইনার সিরিজ”( ২০০১- ২০১১)-কে ভিত্তি করেই নোরা টেওমেয় ( Nora Twomey) পরিচালনায় তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রটি। সংবেদনশীল ‘কোকো’, ‘মওনা’, এমনকি ‘ডিসপিক্যাবল মি ৩’ এর চেয়েও অধিক মর্মস্পর্শী এই ছবিটি, ২০১৭ সালে “টরেন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে”, ‘বেস্ট অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র” হিসাবে ৯০তম একাডেমি পুরস্কার জয় করে নিয়েছে।
গল্প বলার গতি বড় চমৎকার। গল্পের ভিতর আরেক গল্প। সে গল্পে, ছোট বড় পেপার কাট আউটে ডিজিটাল রংচং মুগ্ধ করে আমাদের। গল্পের মূল স্রোতে আছে অনিশ্চয়তা। ১১বছর বয়সী পারভানার প্রতিদিনের সংগ্রাম। যে পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। আফগানিস্তানের তালেবান শাসন তার ছেলেবেলা কেড়ে নিয়েছে। অলিগলি খেলে বেড়ানোর সময়ে ভয় জমা বেঁধেছে মনে। হারিয়ে ফেলেছে অসহায় বাবাকে। সোভিয়েত আফগান যুদ্ধে যে বাবার বাঁ-পা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে শরীর থেকে। শিক্ষক, উদারমুখী বাবাকে বন্দি হতে দেখেছে সেই মানুষগুলোর হাতে, যারা বিনা দোষে পারভানার মত আরো অনেক কিশোরীর খোপ কাটা এক্কাদোক্কা মুছে দিয়েছে। তবু পারভানা নিজের ভালোলাগা, নিজের চোখ বোজা রঙিন স্বপ্নগুলোকে আবারো দ্যাখে। হাতের দুপাতায় মেলে ধরে বন্ধুর হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া চৌকো ছবি, যেখানে সমুদ্রের নীল জল, আকাশের আলো ছড়ানো চাঁদ তাকে ডাকে। গল্পের অন্তঃস্থলে বাসা বাঁধে আরো এক গল্প। বাবার বলে যাওয়া গল্পে নতুন করে চরিত্র স্থাপন করে সে। স্ক্রিন জুড়ে ঝলমলিয়ে ওঠে হাসিখুশি মুহূর্ত। ছোট্ট ভাইয়ের থেকে আড়াল করে, পরিবারের আতঙ্ক। কেঁদে ওঠা শিশু মনে পারভানা হয়ে ওঠে এক অনবদ্য গল্পকথক। কল্পনায় ভিড় করে এলিফ্যান্ট কিং। কোনো এক গ্রামের নৃত্যরত বালক, সাহসী বুকে এগিয়ে যায় লালচোখের জাগুয়ারের আক্রমণ প্রতিহত করতে! ঝড়, তুমুল বর্ষা এমনকি আকাশ জোড়া বিদ্যুতেও ভয় পায় না সেই বালক। তাকে যে ফিরিয়ে আনতেই হবে গ্রামজোড়া সেই খুশির দিনগুলো! এ গল্পের সংযোগ যেন নীরবে পারভানার মন, মননের কথাই বলে! পারভানা লড়তে থাকে। নিজের সঙ্গে। নিজের কিশোরীবেলার সঙ্গে। চুল কেটে, মৃত দাদার পোশাক পরে সে হয়ে ওঠে এক অন্য বালক! বালক ‘অতীশ’। কখনো কারখানায় শ্রমিকের কাজ করে, কখনো হকার সেজে, কোনো আবার গ্রাম্য বালক হয়ে যথাসাধ্য করতে থাকে পিতাহীন পরিবারের জন্য। তাকে যে পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটাতে হবে! ধূলি ধুসরিত কাবুলের কারাগার থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে বাবাকে।মা ফাতেমা-কে বলে, “তুমি তখনই ভালো থাকবে, যখন তোমার পেট ভর্তি থাকবে!” শুকনো আঙ্গুর-ও অতি যত্নে কখনো নিজের, কখনো ভাই জাকি-র মুখে তুলে দেয় সস্নেহে। তার ক্লান্তি আসে। তবে সে দৃঢ়। কঠিন। প্রস্তুতি নেয় বাবাকে ফিরিয়ে আনার। সতর্ক হয়ে উপায় বের করে, মা বড়দিদির নিষেধ সত্ত্বেও। শেষ হয়না পারভানার সেই কল্প-কাহিনীও। দিনশেষে জাকি-র কাছে সে গল্পের আকর্ষণ বাড়ে। ঘটনার ঘনঘটা বাস্তব, ও কল্পরাজ্যের বুনন করে অটুট। শিশু জাকির মত আমরাও অপেক্ষা করি গল্পের শেষ পাতার দিকে! সত্যিই কি পারভানা ফিরিয়ে আনতে পারবে বাবাকে? মা, ভাই, বড়দিদিকে দেওয়া কথা কি রাখতে পারবে সে! অসীম প্রশ্ন, উত্তরের জমাট খুঁজতে গেলে অবশ্যই তোমাদের দেখতে হবে “দ্য ব্রিড উইনার”। যার প্রকৃত অর্থই হলো পরিবারের পাশে থাকা, সঙ্গে থাকা। হোক সে কিশোরী। মনোবল যে কঠিন হিমালয়সম।
গল্পের আরো কয়েকটি ভালো দিক উল্লেখ না করে পারছিনা। চলচ্চিত্রের গান, মাইকেল এবং জেফ ডেননাস-এর। পূর্ব এবং পশ্চিমী ধাঁচের সংমিশ্রণ সাড়া জাগিয়েছে অচিরেই।
অন্যটি কার্টুন সালুন-এর উপস্থাপনা। আলো, ছায়ার যথাযথ প্রয়োগ কাহিনীর গভীরতা বজায় রাখে। ভালো, খারাপের দিকটিও ফুটিয়ে তোলে সুস্পষ্ট করে।
তাই আর দেরি কেন? যারা এখনো ভাবছো পারভানাকে দেখবে কিনা, ওর গল্প শুনবে কিনা! তাদের বলছি আর একটুও দেরি নয়! হয়তো ঝলমলে এলোমেলো হাসি খুঁজে পাবেনা, দেখতে পাবেনা রঙিন পরী! তবুও অনেকটা সাহস সঞ্চয় করতে তো শিখবে! তোমাদের ছোট্ট হাতদুটো দিয়ে বড়দের হাত তো ধরতে শিখবে শক্ত করে! কে বলতে পারে লালচোখের জাগুয়ার কোনোদিন আমাদের দিকেই তেড়ে আসবে না?