সিনেমা হল
“সে এক রূপকথার-ই দেশ”
ছবির নাম ‘কোকো’
রিভিউ করলেন রুমেলা দাস
একটা বাড়ি। ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা মাথায়, ত্রিকোণ আকার। গোটা কতক ফুলঝুরির মত আতশবাজি ফাটছে তারই মাথার উপরে। নাহ, এটা গল্পের শুরু নয়। তবু বলার প্রয়োজন বোধ করলাম। এ হল ডিজনির প্রতীক চিহ্ন। এ-যাবৎ যারা কচিকাঁচা হয়ে কিংবা ওদের বুঝে গুটিকতক সিনেমা দেখেছেন তারা নিশ্চয় সবাই জানেন। ফুল স্ক্রিনে এমন রূপকথার আচ্ছাদনে মোড়া একটা শহর দেখলেই মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। আসছে দেড় বা দুই ঘন্টা যে চোখের পলক না ফেলেই রঙিন কিছু টক-ঝাল-মিষ্টি, শৈশব কৈশোর ফিরে পাব সেই আশাতেই বসি।
সিনেমার নাম ‘কোকো’।
১০ই অক্টোবর, ২০১৭ মেক্সিকোর মোরেলিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হবার পর, সারা বিশ্বে মুক্তি পায় ২২শে নভেম্বর, ২০১৭। প্রযোজক সিডনির সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান পিক্সার। ৭৫তম গোল্ডেন গ্লোবে শ্রেষ্ঠ এনিমেটেড ছবি ও বেস্ট অরিজিনাল সং-এর পুরস্কারও ‘কোকো’-র ঝুলিতে।
গোটা গল্পটা গড়ে উঠেছে মেক্সিকোর ‘দিয়া দা মুয়েরতস’ বা মৃতদের দিন নামক একটি ঐতিহ্যের উপর। প্রতি বছর ৩১শে অক্টোবর থেকে ২রা নভেম্বর পর্যন্ত মেক্সিকানরা তাঁদের মৃত আত্মীয়দের জন্য প্রার্থনা করে থাকে। এ-সময় তাঁরা বিশ্বাস করে, যে-সব মৃত ব্যক্তিদের মনে করা হয়, তাঁরা পরকালেও জীবিত থাকতে পারে। আর যদি কেউ মনে না করে তখন পরকালেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। কী হল? ভয় পেয়ে গেলে নাকি? ভয় পাবার কিছুই নেই। পরকালের জীবনটাও যে কত্ত রঙিন আর ঝকঝকে তা আমরা দেখব এখানেই।
আপাততঃ ‘কোকো’ নিয়ে কিছু বলি। সময়সীমা ১০৫ মিনিট(১ঘন্টা ৪০মিনিট ৪৬সেকেন্ড)। নতুন কিছু ঝলমলে দেখার জন্য চোখ মেলে থাকলাম। পেলামও তাই।
শুরুতেই চমক। পেপার কাটিংয়ের মতো ছোট ছোট চতুষ্কোণ-লাল, নীল, হলুদ, আকাশী যেন রামধনুর সাতরং। তাতেই একটা গল্পের অবয়ব। পরিচালক লি আঙ্করিচ। অস্কার জেতা পরিচালক। গল্পকথক ও প্রধানচরিত্র, মেক্সিকোর ছোট্ট গ্রাম সান্তা সেসিলার ১২বছর বয়সী বালক মিগুয়েল। মিগুয়েলের গলায় আন্থনি গঞ্জালেস। একেবারে অভিনব। একের পর এক অতীত ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে ফুটে উঠছে মিগুয়েলের পরিবারের ভাঙাগড়ার কথা। পরিবর্তন হচ্ছে লাল, নীল, রং। মিগুয়েল বলছে তার গল্প। তাদের গল্প। তার প্রপিতামহের গান ভালোবেসে বাড়ি ছাড়ার গল্প।
তার মেয়ে ‘কোকো’। যে মিগুয়েলের সম্পর্কে প্রমাতামহ তার গল্প। মিগুয়েল তাঁকে আদর করে ডাকে’ মামা কোকো’ বলে। মামা কোকো এখন অশীতিপর বৃদ্ধা। তোবড়ানো গাল, চামড়ার ভাঁজ অসংখ্য। বসে থাকেন হুইল চেয়ারে। বয়স বেড়েছে, কিন্তু মনটা রয়েছে একেবারেই মিগুয়েলের মতই। মিষ্টি মুখের ন্যুব্জ এই বৃদ্ধাকে দেখলে মন ভরে যায়। বয়সের ভারে বারবার ভুলে যান সম্পর্কের নাম। তবু মিগুয়েল ছাড়বার পাত্র নয়। সে বয়সে খাটো হলেও, বুদ্ধিতে বেশ আঁটোসাঁটো। আর তাই তো হাসিতে, গল্পে, কখনো বা মূকাভিনয় করে মাতিয়ে রাখে তার অতি প্রিয় মামা কোকো-কে।
এই হালকা মেজাজেই উঁকি দেয় ১০০বছরেরও পুরোনো অতীত। যেখানে গান গাওয়া মানা। গান শোনা মানা। শুধু সকাল থেকে সন্ধে জুতো তৈরি, জুতো পালিশ, জুতো সেলাই। আর সবাই মিলে একসাথে থাকা। সবাইকে নিয়ে থাকতে মিগুয়েলেরও ভালো লাগে। কিন্তু ওর যে আরো একটা জিনিস খুব খুব ভালো লাগে! গান গাইতে। গান শুনতে। গিটারের টুং টাং সুরে ওর গোটা শরীর নেচে ওঠে। ওর স্বপ্ন গায়ক হয়ে, বিখ্যাত গায়ক নায়ক আর্নেস্তো ডে’লা ক্রুজের মতো গান গেয়ে, গিটার বাজিয়ে সক্কলের মন জয় করতে। কিন্তু ওর বাবা, মা, ঠাকুমা কেউ চায় না এসব শুনতে।
মিগুয়েল গোপনে ওর একটা ডেরাও বানিয়ে ফেলেছে। যেখানে আর্নেস্তো ডে’লা ক্রুজের গান, টেপরেকর্ডার, আর ওঁর কত্ত ছবি মিগুয়েল সাজিয়ে রেখেছে। বারবার মিগুয়েল সে-সবই মুগ্ধ হয়ে দেখে, শোনে। আর অবাক হয়।
অবাক হয় ওর প্রিয় পোষা কুকুরও। ও যেন মিগুয়েলের কথা বোঝে। ভাষা বোঝে। এমনকি ওর রাগ, আনন্দ দুঃখ সবই। লম্বা জিভের অর্ধেক বের করে, জুলজুলে চোখে মিগুয়েলের সঙ্গী হয় সবসময়। মিগুয়েল গিটারের তারে আঙুল ছোঁয়ালে, লেজ নেড়ে অভ্যর্থনা জানায়।
কিন্তু হঠাৎ একদিন মিগুয়েল বাড়ির বাধা মানতে না পেরে পালিয়ে যায়। চুরি করে আর্নেস্তো ডে’লা ক্রুজের গিটার। লাল পাতার ঝড় ওঠে। ও বুঝতেই পারেনা কি হয়!মিগুয়েল সবাইকে দেখতে পায়, কিন্তু মিগুয়েলকে কেউই দেখতে পায়নি। অজান্তেই ও এসে পৌঁছয় মৃতদেহের চাকচিক্যমান এক নগরীতে। ‘ল্যান্ড অব দা ডেড’। কি হলো! মুখ কাঁচুমাচু করছো কেন! তোমরা যেমনটা ভাবছো তেমনটা কিছুই নয়। আরে শোনোই না! কারণ কিছু পরেই মিগুয়েল একটা বন্ধু পেয়ে যায়। নাম টেক্সটার হেক্টর। হেক্টরের গলায় কথা বলেছেন গেইল গার্সিয়া বার্নাল। দুজনে খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ওরা দুজনে মিলে সন্ধান পায় মিগুয়েলের পারিবারিক এক রহস্যের।
কি সেই রহস্য? মিগুয়েল কি ওর বাড়ি ফিরে যেতে পারবে? ওর বাড়ির সবাই কি ওকে গান গাইতে দেবে? দাঁড়াও দাঁড়াও এখনই সব যদি বলে দি তাহলে তো তোমরা ‘কোকো’ দেখবেই না। তাই আর দেরি কেন!! চটপট আজই দেখে নাও মিগুয়েলের স্বপ্ন প্রাণ ভরে। তবে তার আগে ‘কোকো’ ছবির আরো কিছু ভালোর একটি লিস্টি করি, কি বলো!
(১) অন্যতম আকর্ষণীয় গান। মেক্সিকান লোকসংগীত হলেও, প্রতি মুহূর্তে মনে হয় আমাদের খুব চেনা। খুব কাছের কোনো সুর। মন ভালো হয়ে যায়। ফুরফুরে হাওয়া সুর রূপে মন, হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। Remember Me গানটা চোখে জল এনে দেওয়ার মতো। বেঞ্জামিন ব্রাট গেয়েছেন গানটা। মামা কোকো-র স্মৃতি ফিরে আসে এই গানের সুরের হাত ধরেই। এই রিদ্ম-ই আমাদের জীবনের তরঙ্গ ধরে রেখেছে, তা ভাবায় ছোট থেকে বড় সবাইকে। সুরহীন জীবন যেন কঙ্কালসার। তাইতো কঙ্কাল জগতেও দেখি ঘোরতর সুরের অস্তিত্ব।
(২) এত সুন্দর রঙচঙে আর ফেস্টিভ সিনেমা মন জয় করবেই। নানা রঙের কাগজ আর মোমবাতি দিয়ে সাজানো শহর মেক্সিকোর জীবিত ও পরোলোকের শহর যেন এক রূপকথার রাজ্য। যেখানে ভয় নেই, দুঃখ নেই, বেদনা নেই। আছে হাসি মজা আর এগিয়ে যাওয়ার পথে ছোটখাটো গর্ত। যেগুলো আমাদের উৎসাহ, উদ্দমকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
(৩) Story telling বা গল্পকথন অপূর্ব। কিশোর মিগুয়েলের কথায় গল্পের ঠাস বুনন অভাবনীয়। একটুও বোর হবার সুযোগ নেই।
(৪)দারুন ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডলি সিনেমা। গল্প, এডভেঞ্চার, এনিমেশন একেবারে সক্কলকে আনন্দ দিতে ‘কোকো’ সিদ্ধহস্ত।
(৫)মৃতদের শহর চমৎকার। চোখ জুড়িয়ে যায়। ভয় নয়, বরং তাদের জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে আগ্রহ জাগে। মৃতদের শহরটি মেক্সিকান শহর’গুয়ানাজুয়াতো’ আদলেই তৈরি।
(৬) প্রতিটা চরিত্র কি জীবন্ত! যেন মনে হয়, মিগুয়েল ওর পোষা কুকুর, আমার বা আমাদেরই আসে পাশের কেউ। আর মিগুয়েলের বাড়ির সকলেই তো খুবই কাছের। প্রাণ, প্রাণহীন কোথাও যেন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে।
কোকোর গল্পের এপারে ওপারে গান আর গান। মূলত নিজের ইচ্ছাকে জোর দিয়ে আমরা যেন বাবা, মা পরিবারকে না হারাই কোকো নীরবে তাই বলে যায়। মেক্সিকোর ট্রেডিশন, কালচার, আর মিউজিক সব মিলিয়ে কোকো এক অসাধারণ গল্প।
আমি তো আমার পছন্দ বললাম। আর তোমরা?
দেখো, আর লিখে জানাও আমাদের। কেমন দেখলে মামকোকো থুড়ি ‘কোকো’। কী? রাজি তো!