আগের পর্বগুলো
হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের দশটি ঠাট নিয়ে আলোচনা করার সময় মনে রাখতে হবে ঠাটগুলির প্রত্যেকটির নামে এক একটি রাগ থাকলেও রাগ ঠাটের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি সাঙ্গীতিক রূপ। ঠাটের সাথে পাশ্চাত্যের স্কেলের মিল থাকলেও সেই একই ঠাটের একই নামের রাগের সাথে পাশ্চাত্যের ওই তুলনীয় স্কেলের মিল খুঁজে পাওয়া খুবই শক্ত। এই আসাবরী ঠাটের আসাবরী রাগের ব্যাপারেই দেখ যদিও ঠাট বা স্কেল অনুযায়ী শুধু আরোহণ পর্বে এর চরিত্র হল সা, রে, জ্ঞা (কোমল গা), মা, পা, দা(কোমল ধা), ণি(কোমল নি) র্স। এটুকুকে বড়জোর আসাবরী রাগের কাঠামো বলা যেতে পারে যার অস্তিত্ব পাঠ্য বইয়ের বাইরে কোথাও নেই। সাথে দেওয়া লিঙ্ক-এ এই ঠাটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ই-ফ্ল্যাট মেজর স্কেলটি শুনে দেখ। আসাবরী রাগ পরিবেশনের সময় স্বর প্রয়োগ হয় রে থেকে সোজা মা – তে, তারপর নেমে আসে কোমল গা-তে, আবার আরোহণের সময় কোমল নি(ণ) কে ছুঁয়ে স্বর নামে পা -তে, আবার তার(চড়া) সা-তে পৌঁছে বারবার নেমে আসে কোমল ধা(দ) বা পা স্বরে। এইভাবে আরোহণ আর অবরোহণের বিশিষ্ট ছকটি এই রাগটিকে স্কেল বা ঠাটের ধারণা থেকে, এমনকি একই স্বর লাগে এমন অন্যান্য রাগ থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়। এটা সব রাগের ক্ষেত্রেই সত্যি। আরও একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে স্বরপ্রয়োগের ছক এক হওয়া সত্বেও একটা রাগ আর একটা রাগ থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে কোন কোন স্বরের শ্রুতিস্বরের তারতম্যে – যে তফাৎ এখনকার অনেকেরই অজানা আর পাশ্চাত্য স্কেল নির্ভর কোন বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে তা প্রকাশ করাও প্রায় অসম্ভব। এই প্রসঙ্গে বারবার বলা সত্বেও আবার বলতে হয় হারমোনিয়ম জাতীয় অনড় কম্পাঙ্কের বাদ্যযন্ত্রের সাথে ভারতীয় রাগসঙ্গীত পরিবেশন করতে হলে গায়ক বা বাদককে এই অপূর্ণতাটি মেনে নিয়েই চলতে হয় আর তাতে রাগের প্রতি, আর যাই হোক, অনুরাগ প্রকাশের কোন উপায় থাকে না।
আসাবরী ঠাটের জনক বা আশ্রয় রাগ আসাবরী। এই ঠাটে গা ও নি বর্জিত স্বর। দিনের দ্বিতীয় প্রহরে (সকালের দিকে একটু বেলায় – ৯টা থেকে ১২ টা) পরিবেশণযোগ্য এই রাগটির আরোহে জ্ঞ ও দ স্বর দুটি বর্জিত থাকায় আরোহণে পাঁচটি স্বর আর অবরোহণে সাতটি স্বর প্রয়োগ হয়। তাই এটি ঔড়ব-সম্পূর্ণ জাতির রাগ।
আরোহণ – স, র, ম, প, দ, র্স
অবরোহণ – র্স, ণ, দ, প, ম, জ্ঞ, র, স।
রাগটির বাদী স্বর – কোমল ধা (দ), সম্বাদী স্বর- কোমল গা (জ্ঞ)।
পকড় – র ম প, ণ দ প ।
ম প দ প, জ্ঞ র স।
কর্ণাটকি পদ্ধতির নটভৈরবী রাগম্ এর আরোহণ সা, র২, গ২, ম১, প, ধ১ ন২ র্স, আর অবরোহণ -র্স, ন২, ধ১, প, ম১, গ২, র২, স। এর সাথে আসাবরীর মিল নিচের লিঙ্ক-এ শুনে দেখ।
রাগটি বেশ প্রাচীন। শার্ঙ্গদেবের সঙ্গীত রত্নাকরেও উল্লেখ আছে এই রাগটির। আসাবরীর আরেকটি রূপ কোমল ঋষভ আসাবরী (যাতে শুদ্ধ রে’র বদলে শুধুমাত্র কোমল রে ব্যবহার হয়) ভৈরবী ঠাটের অন্তর্গত। এটিই এই রাগের প্রাচীন রূপ। আবার রে স্বরটির শুদ্ধ ও কোমল দুটিই প্রয়োগ হয় এমন একটি রূপও এর আছে। আমরা যে রূপটি নিয়ে আলোচনা করছি, সেটি শুধু শুদ্ধ রে সম্বলিত রূপ। এই আসাবরী ভাতখন্ডেজী গোয়ালিয়র ঘরাণার হদ্দু খাঁ হস্সু খাঁ এবং নত্থু খাঁর গায়ন থেকে সংগ্রহ করেছেন। আলাউদ্দিন খাঁ একবার বলেছিলেন উনি ওয়াজির খাঁ সাহেবের দুই নি ব্যবহার করা আসাবরী শুনেছেন।
আরোহণে কোমল ণ প্রয়োগে এটি জৌনপুরীর মত লাগবে। এই কারণে অনেকে আসাবরী কে শুদ্ধ ঋষভ আসাবরীও বলে থাকেন। তবে আসাবরী (শুদ্ধ ঋষভ) আর জৌনপুরীর মধ্যে পার্থক্যও আছে এরকম –
রাগটির নামের উৎপত্তি নিয়ে কয়েকটি ভিন্ন মতের একটি হল এটি আশা ও ওরি(ভরি) অর্থাৎ প্রিয়জনের আসার অপেক্ষার সময়কার মনের ভাবের ছবি। আরেকটি হল অসি(সাপ) ও অরি (শত্রু) অর্থাৎ সাপুড়ের সুর। এই দ্বিতীয় মতটির প্রতিফলন দেখা যায় মধ্যযুগের কিছু মিনিয়েচার ছবিতে – যার একটি এই লেখার সাথে দেওয়া হল।
পণ্ডিত বিষ্ণুদিগম্বর ভাতখন্ডে’র ‘হিন্দুস্হানী সঙ্গীত পদ্ধতি – ক্রমিক পুস্তক মালিকা’য় কল্পদ্রুমাঙ্কুর, চন্দ্রিকাসার, রাগমঞ্জর্য়াম ইত্যাদি প্রাচীন বইগুলিতে সর্বজনপ্রিয় এই রাগটির বর্ণনা অনুযায়ী এটি মৃদুগামিনী, আরোহণে জ্ঞ, ণ বর্জিতা, অবরোহণে পূর্ণা, দ ও জ্ঞ বাদী সম্বাদী, চলন – রম পণ দপ দর্স, ণদ পম পজ্ঞ রস।
সাথে দেওয়া অডিও লিঙ্ক এ প্রথমে ‘বড়ি বহেন’ সিনেমায় ১৯৪৯ সালে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘চলে যানা নেহি নয়না মিলাকে’, তারপরে ১৯৬৬ তে ‘দো বদন’ ছবিতে গাওয়া ‘লো আ গয়ি উনকি ইয়াদ’, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘কার বাঁশী নিশিভোরে’র পর একটি কর্ণাটকি গীতের অংশ, তারপর ই-ফ্ল্যাট মেজর স্কেল ও ওই স্কেলে বিঠোফেন-এর টেন্থ স্ট্রিং কোয়ার্টেট ও শ্যুবার্ট এর পিয়ানো ট্রায়ো। এরপর DAW সফ্টওয়্যারে বাজানো ত্রিতাল মধ্যলয়ে ভাতখন্ডেজীর বইটি থেকে নেওয়া স্বরলিপি অনুযায়ী ‘আঁখিয়া লাগি রহত নিশদিন’। শেষ অংশে গোয়ালিয়র ঘরাণার আখতার আলি খাঁ ও জাকির আলি খাঁর বিলম্বিত খেয়াল ও আলি আকবর খাঁর সরোদে রাগ আসাবরী।
https://drive.google.com/open?id=0BxIqBj86OOMtMzhmNlo4Y2F6elk
https://drive.google.com/file/d/0BxIqBj86OOMtMzhmNlo4Y2F6elk/view?usp=sharing
‘আঁখিয়া লাগি রহত নিশদিন’ র পণ্ডিত বিষ্ণুদিগম্বর ভাতখন্ডেজীর স্বরলিপি নীচে দেওয়া হল।
আঁখিয়া লাগি রহত নিশদিন
প্যারে তিহারে দেখন কাঁহি।
ঘড়িপল ছিন মোহে যুগসী বীতত
নিশদিন চটপটি লাগ রহত মহিঁ।
রাগ আসাবরীর একটি চিত্ররূপ
অসাধারণ একটি দুষ্প্রাপ্য ছবি [কৃতজ্ঞতা – রাজন পাররিকার আর্কাইভ]
প্রথম ও ত়ৃতীয় অডিও লিঙ্ক শোনা যাচ্ছে না, দ্বিতীয় লিঙ্ক টা কেন আছে বোঝা গেল না।
LikeLike
যেমন জানিয়েছি, অডিও ফাইল ড্রাইভে রেখে লিঙ্ক দিলে শোনার সমস্যা থেকেই যায়। ডাউনলোড করে শুনতে হয়।
সে কারণে নেক্সট এপিসোডের জন্য ড্রাইভ লিংক্ব্র বদলে ইউটিউব বা সাউন্ডক্লাউড লিঙ্ক চেয়ে পাঠিয়েছি।
LikeLike