শ্রীমতি ইংবোর্গ র্যাপোপোর্ট
উমা ভট্টাচার্য
তিনি একজন জার্মান চিকিৎসক। তাঁর দীর্ঘ জীবনের লড়াই ছিল নাজি জার্মানির এক অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানি-নাজি আতঙ্কমুক্ত জার্মানিতে তিনি ছিলেন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চিকিৎসক ব্যক্তিত্ব। তিনি বিশ্বের জ্যেষ্ঠতম ডক্টরেট উপাধিপ্রাপক। তাঁর নাম গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এ অমর হয়ে থাকবে।
যে সময়ে সারা ইউরোপ জুড়ে সংক্রামক ডিপথিরিয়া রোগ অতিরিক্ত শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ ছিল, সেই সময়েই ডিপথেরিয়ার মত মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে তিনি গবেষণা করে থিসিস লিখেছিলেন। ১৯৩৮ সালে জমা দেওয়া তাঁর সেই থিসিসকে আর্যত্বের গর্বে গর্বিত জার্মান নেতারা স্বীকৃতি দিলেন না। সেটা ছিল নাজি জার্মানির উত্থানের সময়। হিটলারের ক্ষমতাসীন হওয়ার ৫ বছর পরের ঘটনা। ইহুদি জাতির সঙ্গে ন্যুনতম সংস্রব আছে এমন সব মানুষকেই তখন নাজি ‘জাতিবৈর আইনের’ আতস কাঁচের নীচে ফেলে বিচার করা হ’ত যে, তার শরীরে কতটুকু আর্যরক্ত আছে। ‘ক-পোয়া আর্য’ সে। সেই ইহুদি সংস্রবযুক্ত মানুষদের শিক্ষা, উচ্চতর শিক্ষা,চাকুরি, অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করাই ছিল আইন। ইহুদি নিধন তখনও পূর্ণমাত্রায় শুরু হয়নি,তাই হয়ত তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর লেখা থিসিস, তা যতই মানুষের কল্যানের জন্য হোক না কেন তা গৃহীত হয়নি সে সময়।
সেই থিসিস অবশেষে গৃহীত হল তাঁর ১০২ বছর বয়সে। ৭৭ বছর অপেক্ষা করতে হল হামবুর্গের মেডিক্যাল একাডেমিক ফ্যাকাল্টির অনুমোদন পেতে। ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’ প্রবচনটি সত্য হল তাঁর জীবনে। সেই ২৫ কি ২৬ বছর বয়সে লেখা থিসিসের হাত ধরে তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রি মিলল জীবনের উপান্তে এসে, ২০১৫ সালে। যা তাঁর একান্ত প্রাপ্য ছিল তা থেকে কেঊ তাঁকে বঞ্চিত করতে পারেনি । হয়ত এই স্বীকৃতির অপেক্ষাই তাঁকে আজীবন কর্মক্ষম রেখেছিল,আর জীবিত রেখেছিল।
বালিকা ইংগিবোর্গ স্যিল্ম বা সাইলেম (Syllm or Sillem) ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট জার্মান পিতামাতার সন্তান।তাঁর পিতা পল ফ্রেডারিক সাইলেম, আর মা মারিয়া সাইলেম ছিলেন প্র্যোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান ধর্মে বিশ্বাসী। পিতা ছিলেন হামবুর্গের বিখ্যাত, ঐতিহ্যশালী ও উল্লেখযোগ্য ‘সাইলেম প্র্যোটেস্ট্যান্ট পরিবার’-এর উত্তরসূরী। জার্মান জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, রক্ষণশীল মানুষটি ছিলেন পেশায় একজন ব্যবসায়ী। বাস ছিল ক্যামেরুনের ক্রিবি নামে এক জার্মান কলোনিতে।
১৯১২ সালের সেপ্টেম্বরে ইংগিবোর্গের জন্মের কিছুদিন পরেই তাঁদের পরিবার চলে যায় হামবুর্গে,সেখানেই তাঁর পড়াশুনা আর বেড়ে ওঠা। মেধাবী ছাত্রী ইংগিবোর্গের ডাক্তারি পড়ার প্রেরণা ছিলেন ডাক্তার অ্যালবার্ট সোয়েৎজার (Schweitzer),একজন জার্মান লুথেরান থিওলজিয়ান ও একজন সহৃদয় চিকিৎসক। ইংগিবোর্গ ১৯৩৭ সালে হামবুর্গ ইউনিভার্সিটি থেকে স্টেট এগজামিনেশন পাশ করলেন একজন চিকিৎসক হিসাবে। পরের বছরেই ১৯৩৮ সালে তিনি পেশ করলেন ডিপথেরিয়া নিয়ে তাঁর গবেষণাপত্র। তাঁর গবেষণাপত্র বাতিল হল, ডিগ্রিও দেওয়া হলনা তাঁকে,কারণ নাজি জার্মানির ‘জাতি বিদ্বেশী আইন’ অনুসারে তিনি ছিলেন একজন ‘মিসক্লিং'(Mischling) ।
নাজি সমাজকর্তারা সেইসব নাগরিককে ‘মিসক্লিং’ বলে অভিহিত করত যাদের বাবা-মায়ের মধ্যে কেউ একজন আর্য অর্থাৎ খাঁটি জার্মান আর অন্যজন ইহুদি বা কোনওভাবে ইহুদিদের সঙ্গে সম্পর্কিত। জার্মানিতে তখন এক ঘৃণ্য সামাজিক পরিস্থিতি, যথেষ্ট উপযুক্ত হলেও কেঊ নিজেকে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করতে চাইলে, ডিগ্রি লাভ করতে হলে তাকে ব্লাড রিপোর্টও জমা দিয়ে প্রমাণ দিতে হত তার খাঁটি জার্মানত্ব। ইংগিবোর্গের গবেষণাপত্রের উৎকর্ষ দেখে তাঁর গবেষণার গাইড অধ্যাপক রুডলফ ডেঘউইট্ৎজ, তাঁর কাজের প্রশংসা করেছিলেন,কিন্তু স্বীকৃতি দিতে পারেননি। আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, তিনি ইংগিবোরের থিসিসটি গ্রহণ করতে পারতেন, কিন্তু সেটা করতে পারেননি জার্মানিতে চালু রেসিয়াল আইনের জন্য। তাঁকেও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল মানবদরদি নানা মত প্রকাশের জন্য।
জার্মান কর্মকর্তারা খুঁজে বের করেছিল যে ইংগিবোর্গের মা মারিয়া খ্রিষ্টান হলেও রক্তসম্পর্কে ইহুদি জাতি উদ্ভুত। ইহুদি মায়ের সন্তান হিসাবে তাঁকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির মিসক্লিং’ বলে চিহ্নিত করে,উচ্চতর শিক্ষার অনুপযুক্ত ঘোষণা করে। তাঁর থিসিস পেপারটি বাতিলের ঝুড়িতে চলে গিয়েছিল,তাঁকে মৌখিক পরীক্ষাও দিতে দেওয়া হয়নি। উন্নতির পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই সময় হাজারে হাজারে অনার্য বলে চিহ্নিত ছাত্র ও শিক্ষককে(ইহুদিদের) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল, অনেকের ঠাঁই হয়েছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প নামক মৃত্যুপুরীতে। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খানিকটা আলাদা হয়েছিল।
তাঁর বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবার আগেই, তিনি ঠিক করলেন এমন অপমানকর পরিস্থিতিতে জার্মানিতে থাকার কোনও অর্থই নেই। ১৯৩৮ সালেই চলে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।নতুনভাবে শুরু করলেন জীবন। ব্রুকলিন, নিউইয়র্ক, বাল্টিমোর, ওহিও প্রভৃতি মেডিকেল স্কুলে ইনটার্নশিপ করলেন। গ্র্যাজুয়েশন করলেন ফিলাডেলফিয়াস্থিত ‘উইমেনস্ মেডিকেল কলেজ অফ পেনসিলভানিয়া’ থেকে, এম ডি ডিগ্রিও পেলেন।
কর্মজীবন শুরু করলেন সিনসিনাটি হসপিটালে। ১৯৪৬ সালে বিয়ের পর যুগ্মভাবে অনেক সাফল্য লাভ করলেন। তাঁর স্বামী স্যামুয়েল মিটজা র্যাপাপোর্ট ছিলেন একজন দক্ষ চিকিৎসক ও বায়োকেমিস্ট। জাতিতে তিনিও ছিলেন ভিয়েনার একজন ইহুদি উদ্বাস্তু। ‘রক্ত স্ংরক্ষণ’ নিয়ে অভূতপুর্ব কাজের সাফল্যের জন্য প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের কাছ থেকে স্যামুয়েল ‘সার্টিফিকেট অফ মেরিট’ পেলেন।
এর প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই স্ত্রী ইংগিবোর্গ সিনসিনাটি চিলড্রেন হাসপাতালের শিশুবিভাগের প্রধান পদে উন্নীত হলেন। মানবদরদি ইংগিবোর্গ সেখানে কাজ করতে করতেই প্রত্যক্ষ করলেন দরিদ্র, কালো মানুষদের দীনতম অবস্থা। তাদের অধিকার আর অবস্থার পরিবর্তনের কাজ করতে গিয়ে পরোক্ষে জড়িয়ে পড়লেন রাজনীতিতে। স্বামী ছিলেন কমিউনিস্ট। তাঁরা দুজনে প্রতি রবিবার সকালটা কাটাতেন সিনসিনাটির দরিদ্র দিনমজুরদের বস্তিতে,অভাবী এই মানুষদের মধ্যে তাঁরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিতরণ করতেন।
সিনসিনাটির গোয়েন্দারা শীঘ্রই তাঁদের কাজের খোঁজ পেয়ে গেলেন। ‘আন-আমেরিকান অ্যাকটিভিটিস কমিটি’ ইংগিবোর্গ আর তাঁর স্বামী, দুজনের বিরুদ্ধেই কমিউনিস্টসুলভ কার্যকলাপে যুক্ত থাকার প্রমাণ অনুসন্ধান শুরু করল।
সে’সময় মিষ্টার র্যাপোপোর্ট গিয়েছিলেন জ্যুরিখে এক কনফারেন্সে, বিপদের আঁচ পেয়ে তিনি ইউরোপেই রয়ে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যেই সন্তানসম্ভবা ইংগিবোর্গে, তিন সন্তানকে নিয়েই পাড়ি দিলেন ইউরোপে। ১৯৫০ সালে তাঁরা আমেরিকা ছাড়লেন। প্রথমে গেলেন অষ্ট্রিয়ায়, সেখানে কাজকর্ম পাওয়ার সুযোগ কম ছিল। কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে ১৯৫২ সালে চলে গেলেন পূর্ব জার্মানিতে। সেখানে তিনি নবজাতকদের জন্য একটি ক্লিনিক খুললেন। বার্লিনের চ্যারিটি হাসপাতালে খুললেন নিওন্যাটোলজি ক্লিনিক, বার্লিনে সেই প্রথম এই ধরনের ক্লিনিক স্থাপিত হল তাঁর প্রচেষ্টায়। সেখানেই তার চার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা হল। আজ তারা প্রত্যকেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। বড়োছেলে টম র্যাপোপোর্ট হাভার্ডের মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক। অপর ছেলে মাইকেল র্যাপোপোর্ট বন ইউনিভারসিটিতে গণিতবিদ।
এই সময় তাঁর অপ্রাপ্ত ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার ক্ষীণ আশা দেখা দিল পুত্র টমের চেষ্টায়। হার্ভার্ডে কর্মরত টম একদিন কথাপ্রসঙ্গে তাঁর মায়ের থিসিস অগ্রাহ্য হবার কাহিনীটি গল্প করলেন হামবুর্গ ইউনিভার্সিটির মেডিকাল ফ্যাকাল্টির তৎকালীন ডিন-এর সঙ্গে। ডিন ডক্টর ইউ কখ-গ্রোমাস বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করলেন।
অনেক বাধা অতিক্রম করে ডিন সফল হলেন। তাঁর দাখিল করা থিসিসটি নাজি কর্মকর্তারা নিশ্চয় নষ্ট করে ফেলেছিল,সেটি খুঁজ়ে পাওয়া গেল না। এছাড়া তাঁর মৌখিক পরীক্ষারও রেকর্ড ছিল না। তাঁকে একটি মৌখিক পরীক্ষা দিতে হবে ঠিক হল। এজন্য তিনি নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। তখন তার দৃষ্টিশক্তি প্রায় শূন্য। তিনি চোখে না দেখলেও প্রতিবেশী বা বন্ধুদের কারো সাহায্যে ইন্টারনেট থেকে সব নতুন আবিষ্কারের বিষয়ে বিশদে জেনে নিতেন। এমনই ছিল তাঁর অধ্যবসায়।
হামবুর্গ ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি থেকে তিনজন অধ্যাপক এলেন তাঁর বাড়িতে,বার্লিনে। মৌখিক পরীক্ষা নিতে। অনেক সময় ধরে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বললেন তাঁরা, যুদ্ধপূর্বোত্তর জার্মানিতে তাঁর লেখা থিসিসের বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা যাচাই করলেন। সাক্ষাৎকার নিতে আসা তিনজনের দলের অধ্যাপকেরা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তাঁর থিসিসের হুবহু বর্ণনা পেলেন আর ডিপথেরিয়া বিষয়ে আধুনিক আবিষ্কারের বিষয়ে সব তথ্যই তিনি তাঁদের জানালেন। পরিদর্শনকারী দল মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা পরীক্ষা করে অত্যন্ত প্রীত হলেন, ও তাঁকে ন্যায্য পাওনা পি এইচ ডি ডিগ্রি দেওয়া হবে স্থির করলেন। হামবুর্গের মেডিকেল ফ্যাকাল্টি নাজি জমানায় তাঁর প্রতি হওয়া অবিচারের প্রায়শ্চিত্ত করল। হামবুর্গ ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারে এক অনুষ্ঠান করে তাঁর হাতে ডিগ্রি তুলে দেওয়া হল।
২০১৫ সালের জুন মাসে তিনি হলেন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সে ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া মানুষ। ডিগ্রি পেয়ে খুশি হয়ে তিনি বলেছেন ” ১০২ বছর বয়সে পরীক্ষা দেওয়াটা খুব সহজ নয়।আর এই ডিগ্রি তেমন কোনও কাজে আসবে না। তবু এটা গ্রহণ করলাম, কারণ এটা একটা নীতির প্রশ্ন। আমি আমার থিসিসের মর্যাদা চাইনি। আমি এটা নিয়েছি নাজিদের হাতে লাঞ্ছিত,নিপীড়িত অজস্র গুণী ও সাধারণ মানুষের পক্ষে।”
পুর্ব জার্মানিতে তাঁকে দেওয়া পুরষ্কারের মধ্যে আছে প্যাট্রিওটিক অর্ডার অফ মেরিট,ন্যাশন্যাল প্রাইজ অফ জার্মানি। শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনাতে তাঁর কৃতিত্বের জন্য তাকে এইসব সম্মান দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৩ সালে অবসর নেওয়ার পর তিনি একজম বিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করে গেছেন ৮০ ছর বয়স পর্যন্ত। তারপর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যায় ধীরে ধীরে। ২০০৪ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি বার্লিনেই আছেন।
কী ঘোর জাতি বিদ্বেষ😢 আজও কী পুরো মুছে গেছে?
LikeLike