শেষ অভিবাসীদের দলটি রওয়ানা হয়ে গেছে। নির্জন গ্রহটি এইবারে একেবারে জনশূন্য। দুশো মাইল চওড়া অতিকায় পাহারাদার যুদ্ধযানটি পাঁচ মিলিয়ান মাইল দূর থেকে গ্রহটির দিকে তার সমস্ত কামানগুলো নিশানা করে ধরল— “চলো হে বেন, যাবার আগে পাথরের টুকরোটাকে এইবার ভাঙা যাক,” অস্ত্রের বোতামের ওপর হাত রেখে জিক হাসছিল। “আহা এখন না হয় হাওয়া, জলটল শেষ, কিন্তু ও যে আমাদের মাতৃগ্রহ। এইভাবে গোলা মেরে তাকে গুঁড়িয়ে দেবে?” “দেব না? ওর পেটের ভেতর কী আছে জানো? সোনা—বেন, সোনা! এত সোনা যে তা দিয়ে গোটা গ্রহটার গায়ে এক ফুট মোটা একটা ঢাকনা বানিয়ে দেয়া যায়-”
গ্রহের নামঃ পৃথিবী।
সময়ঃ সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে।
সূর্যের চারপাশে তৃতীয় কক্ষপথে ঘুরন্ত শিশুগ্রহ প্রাকপৃথিবী। তার বুকে প্রাণের সাড়া নেই। পাথর, শুধু পাথর। বয়স তখন মাত্রই দশ কোটি ছাড়িয়েছে। এমন সময় একদিন হঠাৎ সে কেঁপে উঠল এক প্রলয়ংকর মহাজাগতিক সংঘর্ষে। তার ঘন, অস্বচ্ছ আবহাওয়ার সঙ্গে ঘষা খেয়ে দাউ দাউ করে জ্বলতে জ্বলতে তার বুকে এসে আছড়ে পড়ল অন্য একটা গ্রহ। আয়তনে সে এখনকার মঙ্গলগ্রহের মতন। ধাক্কা খেয়ে পৃথিবীর সঙ্গেই জুড়ে গেল অতিথি গ্রহটা। আর, সে ধাক্কায় পৃথিবীর কোল থেকে আকাশে ছিটকে গেল একরাশ পাথরের তৈরি চাঁদের টুকরো ছেলেমেয়ে।
সেই চাঁদের টুকরোরা তারপর একসঙ্গে জুড়ে গিয়ে জন্ম নিল পৃথিবীর একমাত্র সন্তান চাঁদ। প্রাকপৃথিবী আর থিয়া (বিজ্ঞানিরা সেই অচিনদেশের রাজপুত্তুর পাথরের এই নামই রেখেছেন) জুড়ে গিয়ে পৃথিবীটা বড়োসড়োও হয়ে উঠেছে তখন বেশ অনেকটাই। তার থেকে মাত্রই চোদ্দো হাজার মাইল দূরে আকাশে বসে চাঁদ এইবারে অভিকর্ষের টানাপোড়েণ দিয়ে তার মায়ের ঘুর্ণনটাকে আস্তে আস্তে থিতু করে দিল। তাইতে পৃথিবীর দিনরাত্তিরের হিসেবটাও বেশ ঠিকঠাক হয়ে গেল। সেইটে ছিল এই গ্রহের বুকে প্রাণ তৈরি হবার একটা প্রধান শর্ত।
তবে সে হলে কী হয়, তখন পৃথিবীতে প্রাণ তৈরি হয় এমন সাধ্য কী? থিয়ার সঙ্গে ধাক্কার এমন তেজ যে তার থেকে তৈরি তাপে গোটা পৃথিবীর সব পাথরটাথর গলে গিয়ে বদলে গেছে একটা ফুটন্ত লাভার সমুদ্রে।
সেই লাভার সমুদ্র কিন্তু সবটাই একরকম ছিল এমন ভেবো না। ধরো এক গেলাস জলে খানিক মাটি আর সর্ষের তেল ঢেলে আচ্ছা করে ঘুঁটেছ। এইবার গেলাসটাকে খানিক নিজে নিজে থাকতে দিয়ে একপাক ঘুরে এসে দেখ দেখি! কী দেখবে? দেখবে, তার সবার তলায় রয়েছে কাদাজল, তার ওপরে পরিষ্কার ফটিকজন আর তারও ওপরে ভাসছে হলদে সর্ষের তেল। যে যত হালকা সে উঠেছে তত ওপরে আর যে যত ভারী সে থিতিয়েছে ততই তলায়। ধাক্কার ঠেলাঠেলি কাঁপুনিটাপুনি থেমে এলে পৃথিবীর লাভার সমুদ্দুরেও সেই দশা হল।
ভুবনজোড়া সেই লাভাসাগরে হালকাপলকা অ্যালুমিনিয়াম আর সিলিকা(বালিতে যা থাকে) ভেসে উঠল ওপরে। তারপর ঠান্ডা হয়ে গিয়ে তৈরি করল পৃথিবীর পাতলা খোসাটাকে, যার ওপরে আমরা থাকি। আর, যত ভারী ভারী জিনিস, যেমন লোহা, নিকেল, প্ল্যাটিনাম আর সোনা ছিল সেই আগুনসাগরে, সেইসবই ডুব মারল সমুদ্দুরের তলার দিকে। থামল এসে তারা পৃথিবীর একেবারে পেটের কাছে। ভূত্বক থেকে আঠারোশ মাইল নীচে এক অতিকায় গলিত, উত্তপ্ত গোলকের চেহারা নিয়ে সৃষ্টি হল পৃথিবীর অবিশ্বাস্য রত্নাগার। সেইখানে জমা রইল তার সমস্ত সোনা, সমস্ত প্ল্যাটিনাম।
কতটা সোনা? সে তো সেই সেনাপতি জিক-এর কথাতেই শুনলে গল্পের শুরুতে। ও দিয়ে গোটা পৃথিবীটাকে এক ফুট মোটা একটা সোনার চাদরে মুড়ে দেয়া যাবে।
কিন্তু তাই যদি হবে, সব সোনাই যদি অতকোটি বছর আগে তলিয়ে গেল, তাহলে পৃথিবীর চামড়াতে এত্ত এত্ত সোনার খনি, প্ল্যাটিনামের খনি এলো কোত্থেকে?
প্রশ্নটা শুনে একজন আমাকে বলল, হয়ত অগ্ন্যুৎপাতে লাভাদের সঙ্গে উঠে এসেছে খানিক সোনা? হতেও তো পারে? সেই শুনে খুঁজেপেতে দেখলাম, উঁহু। আগ্নেয়গিরির লাভাটাভায় সোনা মেলে না এক কুঁচিও। কাজেই সে পথে ও সোনা আসে নি নিশ্চয়।
তবে? কোত্থেকে এল সেই সোনা?
সে রহস্যেরও জবাব খুঁজতে দুনিয়া তোলপাড় করে ফেলছেন বিজ্ঞানিরা। হাজারো তত্ত্ব তৈরি হচ্ছে তাঁদের গবেষনাগারে আর অংকের খাতায়। তার মধ্যে যে তত্ত্বটা ইদানিং জোরদার সেই নিয়েই এর পরের গল্প। সে তত্ত্ব বলে, যত স্বর্ণখনি আর প্ল্যাটিনামের খনি আছে ভুস্তরের ওপরতলায়, তার সব সম্পদ পৃথিবীতে এসেছিল মহাকাশ থেকে। অনেক কাল ধরে পৃথিবীর বুকে নেমে আসা মহাজাগতিক অতিথিদের দান সেসব দামি জিনিসপত্র।
বেশ সহজবোধ্য ভাবে লেখা নিবন্ধটি বেশ ভালো লাগলো পড়তে।
LikeLike