“সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা—”
রেডিওতে এই গানটা শুনতে গিয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল আমার। কেন জানো? যে এই গানটা লিখেছে সে জানে না, তেমন একটা সোনাঝরা দিন সত্যিই পৃথিবীর কপালে এসেছিল। ঠিক দিন নয়। ঠিকঠাক বলতে গেলে গানটা হবে “সেদিনের সোনাঝরা কুড়িকোটি বছ-অ-অ-অ-অ-র”। ঠিক তাই। অতটা সময় ধরেই পৃথিবীর বুকে আকাশ থেকে ঝরে পড়েছিল সোনা, প্ল্যাটিনামের মতন দামি দামি জিনিসপত্তর। আর যখন তা পড়েছিল তখন এমন আগুণ লেগেছিল তাতে যে সে কথা জানতে পারলে ও গানটা মোটেই লিখতেননা কবিমশাই। চলো ডুব দিয়ে দেখি এই গ্রহের ইতিহাসের পাতায়—ঠিক কী ঘটেছিল সেইসব সোনাঝরা দিনে
চাঁদের জন্মের পঞ্চাশ কোটি বছর বাদে পৃথিবী খানিক ঠান্ডা হতে তার চামড়ার খানিক খানিক জমাট বাঁধতে শুরু করল। (জেনে রেখো, এই সময় তৈরি হয়েছিল কানাডার নর্থওয়েস্ট টেরিটোরির গ্রিনস্টোন বেল্ট, পৃথিবীর প্রাচীনতম পাথুরে জমি।)
এমন সময় শুরু হল আরেক উৎপাত। তবে সে উৎপাতের গল্প বলবার আগে আমার মায়ের নারকোলের মিঠাই বানাবার গল্প একটুখানি বলে দি। মা করতেন কি, নারকোল কোড়া আর চিনি মিশিয়ে উনোনে বসিয়ে গরম করে সেটাকে বেশ একটা মাখোমাখো ঘোঁট বানিয়ে নিতেন প্রথমে। তারপর সেইটে যখন আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে আসছে তখন তার মধ্যে বাদাম, পেস্তা, আখরোটের টুকরো, কিশমিশ , এলাচ এইসব ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতেন আর নাড়াতেন। তার ফলে যখন সেটা জমে যেত, তখন তার মধ্যে আমরা খুঁজে পেতাম দারুণ দারুণ সব ভালো ভালো জিনিসপত্তরের টুকরো। তা পৃথিবীর ঘোঁটটা যখন শুকোতে শুরু করেছে, প্রকৃতি মা-ও সেই কায়দায় তার মধ্যে ভালো ভালো জিনিসপত্তর ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে শুরু করলেন, আর সেইসঙ্গে শুরু করলেন ভূমিকম্প আর অগ্ন্যুৎপাতের নাড়াচাড়া। কী করে তা ঘটল সেই কথাটা বলি।
সৌরজগতের ভেতরবাড়িতে আছে বুধ থেকে মঙ্গল এই চারটে পাথুরে গ্রহ। তারপর গ্রহাণূপুঞ্জের বেড়া। তার ওধারে রয়েছে সৌরজগতের মাঝবাড়ি। সেইখানে থাকেন গ্যাসদানব মহাকায় গ্রহরাজ বৃহস্পতি শনি আর ইউরেনাস। তার বাইরে সৌরজগতের বাহিরবাড়ি। সেইখানে, কুইপার বেল্ট আর উর্ট মেঘমালার ভেতরে রাজ্যের ধূমকেতু আর উল্কাদের বাস। তাদের রাজা হলেন প্লুটো। যে সময়ের কথা বলছি, তখন গ্রহাণুপুঞ্জের বেড়ার ওধারে মহাকায় গ্যাসদানবেরা তাঁদের কক্ষপথে অদলবদল ঘটাচ্ছিলেন। আর তার ফলে ভয়ানক অভিকর্ষের টানাপোড়েন তৈরি হচ্ছিল সৌরজগত জুড়ে। সেই টানাপোড়েনে কুইপার বেল্ট আর গ্রহাণু বলয় থেকে সোনা, লোহা, প্ল্যাটিনামে বোঝাই সব গ্রহাণু আর ধুমকেতুর দল ছিটকে ছিটকে এসে আছড়ে পড়তে শুরু করল ভেতরবাড়ির ছোটোখাটো চার গ্রহের গায়ে-মাথায়।
প্রায় কুড়ি কোটি বছর ধরে চলেছিল এই ভয়াবহ উল্কাবৃষ্টির পালা। বিজ্ঞানিদের হিসেব বলে ওতে পৃথিবীর মাটিতে এসে মিশেছিল সোনা, প্ল্যাটিনাম আর অন্যান্য উপকরণ মেশা মোট কুড়ি বিলিয়ন বিলিয়ন টন বস্তু। আর তাদের ধাক্কার উত্তাপে ফের গলে গিয়ে সেই গ্রহাণুদের উপাদানকে নিজের শরীরে মিশিয়ে নিতে নিতে দ্রুত শক্ত হয়ে উঠছিল পৃথিবীর ওপরের ত্বক। তৈরি হচ্ছিল আমাদের পায়ের নিচের শক্ত জমিটা যাকে আমরা ভুত্বক বলে জানি। তার খাঁজে খাঁজে জমা রইল গ্রহাণূদের বয়ে আনা সোনা আর প্ল্যাটিনাম আর অন্যান্য মূল্যবান ধাতুদের ভাঁড়ার। আজকের মানুষ খনি খুঁড়ে খুঁড়ে সেই ভিন আকাশ থেকে আসা ধাতুদেরই তুলে এনে গয়না বানায়। কিন্তু, পৃথিবীর আসল সোনার যে ভান্ডার তার নাগাল সে আজও পায়নি। সে ভাণ্ডার লুকোনো আছে মাটির গভীরে, পৃথিবীর আঠারোশো মাইল পুরু পাথরের আবরণের ভল্টের ভেতর, গলিত ম্যাগমার সমুদ্রের মধ্যে। তাকে ছিনিয়ে নেবার মতন যন্ত্র এখনো মানুষের নাগালের বহু বাইরে।
এই ধূমকেতু আর উল্কাদের আছড়ে পড়া যে পৃথিবীর বুকে শুধু সোনা, প্ল্যাটিনাম এইসব বয়ে আনছিল তা-ই নয়। তার থেকেও আশ্চর্য আর গভীর এক ম্যাজিক তৈরি করছিল তারা পৃথিবীর বুকে। এখনো সে ম্যাজিক দেখাতে পেরেছে এমন কোন জায়গার সন্ধান মেলেনি মহাবিশ্বের কোটি কটি নক্ষত্রের দেশে। তা হল প্রথম প্রাণের স্পন্দন। কেমন করে প্রাণ এল পৃথিবীতে সেই রহস্য নিয়ে বিজ্ঞানিদের কৌতুহলের শেষ নেই। নানান তত্ত্ব খাড়া করা হয়েছে এ নিয়ে। আগুণ, পাথর আর রাসায়নিক ধোঁয়ায় ভরা একটা নরককুণ্ডে কেমন করে প্রথম প্রাণের সাড়া জেগে উঠল তা জানতে না পারলে আমাদের মানুষদের আদিকালের গল্পটা যে আধরাই থেকে যায়, তাই না? ইদানিংকালে এমন কিছু আবিষ্কার ঘটেছে যার থেকে মনে হচ্ছে ওই উল্কাবৃষ্টিই ছিল সেই প্রাণের উৎস। সে গল্প পড়তে পরের এপিসোড দেখ নীচের লিংকে
খুব সরল করে লেখা এক জটিল তথ্যপূর্ণ বিষয়।
LikeLike