আমার বাবা- পর্ব ১ পর্ব ২
এই লেখকের আরো লেখা শুদ্ধ ভক্তের ঘড়ি , ভগবানের বেটা বেটি , আজব মানুষের গজব কাহিনি ,
চুমকি চট্টোপাধ্যায়
বাবাকে নিয়ে আগের দুই কিস্তিতে যেটুকু তোমাদের বলেছি তাতে তাঁর চরিত্রের দৃঢতার একটা আভাস হয়ত তোমরা পেয়েছ। গলার স্বর যদি তোমাদের শোনাতে পারতাম! কী গুরুগম্ভীর সে আওয়াজ!
আমার নিজে চোখে দেখা একটা ঘটনার কথা বলি। হেমপ্রভা প্রিন্টিং হাউসের ( এখনো যে প্রেসে আমাদের প্রকাশনার বেশির ভাগ কাজই হয়) ম্যানেজারবাবু তখন অজিত দাশগুপ্ত। নিপাট ভালোমানুষ এবং তার থেকেও বেশি, কাজের ব্যাপারে আপাদমস্তক সিরিয়াস একজন ভদ্রলোক।
মানুষ মাত্রেই ভুল হয়। তেমনি কাগজ বাছাই সংক্রান্ত কোনো একটা ভুল অজিতদা করে ফেলেছিলেন। বাবার কানে সে কথা পৌঁছল। তিনতলার সিঁড়ির মুখ থেকে বাবা যশুরে টানে ডাকলেন একতলার অফিস ঘরে বসে থাকা অজিতবাবুকে।
– অ-জি-ত…( ‘ জ ‘ কে ইংরিজির z এর মতো উচ্চারণে ভাবলে বোঝা যাবে সঠিক শব্দটা)।
– আজ্ঞে যাই বড়দা। কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর শোনা গেল অজিতদার। কোন কারণে আমি আশেপাশেই ছিলাম। কেমন একটা কৌতুহল হওয়াতে বাবার পেছনে খানিকটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ালাম। দেখলাম অজিতবাবু এসে দাঁড়িয়েছেন বাবার সামনে। রীতিমতো কাঁপছেন।
এমনিতেই তিনি অত্যন্ত নিরীহ রোগাভোগা মানুষ। তার ওপর বাবার ওই ডাকে একেবারে নড়বড়ে হয়ে পড়েছিলেন। আমি তো অবাক! বুঝতে পারলাম কী প্রচন্ড ভয় পান এঁরা বাবাকে। অজিতবাবুর জায়গায় বাঘবাবাজি থাকলেও হয়ত বেড়ালের মতোই আওয়াজ করে কাঁপতে কাঁপতে বাবার পায়ে পড়ত ( এটা নিতান্তই আমার কল্পনা)।
অজিতবাবু ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেন। বাবা বললেন, “দেখো, এমনটা জ্যানো আর কক্ষনো না হয়। যাও কাজ করো গিয়ে।”
এবার আর একটা ঘটনা বলি। যে অঞ্চলে আমাদের অফিস সে জায়গা জল জমার জন্য বিখ্যাত। আকাশে মেঘ ডাকলেই পায়ের পাতা ডোবা জল দাঁড়িয়ে যায়। বর্ষার সময় তো কথাই নেই। পাক্কা ভেনিস!
এরকমই বর্ষার একদিন সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টি। বেলা দশটায় আমাদের অফিসের একতলা জলে ডুবে গেছে। আমহার্স্ট স্ট্রিটে মাঝারি মাপের মানুষের গলা অবধি জল। অফিসের সামনে বুক সমান।
তড়িঘড়ি সমস্ত লোকজন ডেকে কাগজপত্র দোতলায় তোলা হল। আমার তো ভয় লাগছে আরো বৃষ্টি হলে জল দোতলায় না উঠে আসে। বাবা দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে তদারকি করছেন সব কিছু। দুশ্চিন্তা যে হচ্ছে ওঁর বোঝাই যাচ্ছে। এমন সময় আমাদের অফিসের গেটের সামনে ডুব সাঁতার দিয়ে যেন ভেসে উঠলেন অজিতবাবু । চমকে গেলেন বাবা।
– একী? অজিত তুমি? এই দুর্যোগের মধ্যে? তোমার কি মাথা খারাপ?
– আজ্ঞে না মানে… জল যে প্রচুর জমবে তা তো বুঝতেই পেরেছি… এত কাগজ রাখা নীচে… তাই ভাবলাম একবার যাই…
মেঘ ডেকে উঠল বাবার গলায়, “অ, তাই ভাবলে একবার যাই! বাহ! কী চমৎকার কথা! বিদ্যাসাগর বেঁচে থাকলে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতেন। তাঁকে নিয়ে সমুদ্র পাড় হবার যে মিথ আছে, তা তুমি সত্যি করে দেখালে।”
বাবার ডাকে অজিতবাবু এমনিতেই কাঁপেন তার ওপর জলে ভিজে ঠান্ডায় আরও কাঁপতে লাগলেন।
– উঠে এসো, উঠে এসো।
– না আজ্ঞে… কাগজ যখন সব সরানো হয়ে গেছে তখন আমি যাই…
– তুমি ওঠো ওপরে আমি বলছি। কথা কম বলো। চুমকি মা, তুমি অজিতকে একটা তোয়ালে, ত্রিদিবের পাজামা, পাঞ্জাবি দাও। অজিত, তুমি বাথরুমে গিয়ে ভালো করে গা হাতপা ধুয়ে শুকনো জামাকাপড় পরে নাও চটপট। এমনিতেই তোমার হাঁপানি আছে তার ওপর গলা জল ঠেলেছ। আক্কেলের বলিহারি!
অজিতবাবু মাথা নীচু করে বাবার আদেশ পালন করলেন। তারপর আমাদের সঙ্গে বসে গরম খিচুড়ি, বেগুনি, আলুভাজা, মাছভাজা খেলেন৷ বাবা অনেক গল্প করলেন খেতে বসে। অজিতবাবুর কাছে বাবার এই চেহারাটাও নতুন। কী যে খুশি হলেন মানুষটা!
তাহলে কী বুঝলে? বাবা পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে প্রকাশ করতেন। যখন শক্ত হওয়া দরকার, শক্ত হতেন। আবার যখন কারও সাহায্যের দরকার তখন দরাজ হয়ে সাহায্য করতেন। বাবা ছিলেন পুরোদস্তুর নারকোলের মতো– বাইরেটা শক্ত, ভেতরটা নরম। আমি যত দেখতাম, অবাক হতাম।
ন’বছর বাবার সান্নিধ্য পেয়েছি। কত কথা যেমন মনে পড়ছে আবার ভুলেও গেছি কত কিছু। বাবা চলে গেছেন ১৯৯৫ সালে। চব্বিশ বছর হয়ে গেল। টুকরো টুকরো ঘটনা মনে পড়ছে। সেগুলোই তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি।
একদিন সন্ধেবেলা ত্রিদিব বাবাকে নিয়ে চোখের ডাক্তারবাবুর কাছে গেল। বাবাকে দেখতেন সে সময়ের নামকরা অপথ্যালমোলজিস্ট ডাঃ সুনীল বাগচী। সন্ধে গড়িয়ে রাত নামল। আটটা, নটা, দশটা…। মায়ের চিন্তা শুরু হল। তাহলে কি চোখের কোন গুরুতর অসুখ ধরা পড়ল? বাবার চোখ দুর্বল ছিল আগেই বলেছি।
ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছাড়াতে আমারও ধুকপুকানি শুরু হল। তোমারা হয়ত ভাবছ, আরে, এতে চিন্তার কী আছে? একটা ফোন করে জেনে নিলেই তো মিটে যেত! কিন্তু তা তো হবার নয়। সে-সময় ল্যান্ড লাইনই ছিল একমাত্র ভরসা। মোবাইল তখন আশমানে কুসুম হয়ে দুলছে।
মায়ের ফোন নম্বর লেখা ডায়েরি ঘেঁটে ডাক্তারবাবুর বাড়ির টেলিফোন নম্বর বের করলাম। ডায়াল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফোন করলাম বার পাঁচ ছয়। কেউ ধরল না।
রাত ক্রমশ বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটা পিএম থেকে এএমে পা রাখল। রাত বারোটা — সাড়ে বারোটা। মা পায়চারি করছেন বারান্দায় আর আমার গলা তখন সাহারা মরুভূমি। যত জলই ঢালি না কেন ভিজছেই না।
মা বলেই চলেছেন, “কী আশ্চর্য! ডাক্তারবাবুর ফোন থেকে একটা ফোন তো করবে!” আর আমি তখন দিশেহারা। কী করা উচিত, মাথায় আসছে না। শেষে কেমন ক্লান্তি ঘিরে ধরল আমাকে। বসে পড়লাম ঘরের মেঝেতে। সে-সময় ত্রিদিবই গাড়ি চালাত। ধরেই নিলাম কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া আর কীই বা হতে পারে! চিন্তা করতে করতে মা এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন। অতি চিন্তা এক ধরনের ক্লান্তি আনে।
একটা বেজে গেল। দুচোখ ভিজে উঠেছে আমার। আমার বাবাকে ফোন করে জানাবার কথা ভাবছি। বাপি যদি কিছু ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু অত রাতে… চিন্তার জট অবশ করে দিচ্ছে মস্তিষ্ক। ভাবতে ভাবতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা কুড়ি। নাহ, বাপিকেই ফোন করি। আমার বাবা তখন ডিএসপি সিআইডি। আমার মুশকিল আসানের চাবিকাঠি।
মা যেখানে ঘুমোচ্ছেন সেখানেই ফোন। ফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র পরিচিত একটা শব্দ যেন কানে এল। যদিও খানিক দূর থেকে।
বাবার ছিল কালো অ্যাম্বাসাডর। ৫০৬০ নম্বরের গাড়িটার হর্নের আওয়াজটা ছিল অন্যান্য গাড়ির থেকে একটু আলাদা। ক্ষীণভাবে সেই আওয়াজই যেন আমার কানে এল। দাঁড়িয়ে গেলাম স্থির হয়ে।
মিনিট তিনেক বাদে গাড়ি থামার শব্দ পেলাম বাড়ির সামনে। তারপর মেন গেট খোলার শব্দ… বাবার জুতোর মসমস শব্দ… ত্রিদিবের চটির শব্দ।
দরজা খুলে দিলাম। আমার বিস্মিত চোখ দেখে বাবা বুঝলেন ভেতরের উদ্বেগ। বললেন, “গল্প করতে করতে সময়ের খেয়াল ছিল না বুঝলে মা। একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল।” বাবার কথা শুনে রাগব না হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। ইতিমধ্যে আওয়াজ পেয়ে মা-ও উঠে পড়েছেন।
– ব্যাপারখানা কী অ্যাঁ? এটা ডাক্তারখানা থেকে ফেরার সময়? বাড়িশুদ্ধু লোকের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে চিন্তায়! যেমন বাবা তেমন ছেলে! ডাক্তারবাবুও বলিহারি। তাড়িয়ে দিলেন না কেন তোমাদের?
পরিস্থিতি প্রতিকূল বুঝে বাবা কথা বাড়ালেন না। আর ত্রিদিব তো বাবার ঘাড়ে বন্দুক রেখে টোটা চালিয়েই যাচ্ছে। “কখন থেকে বলছি বাবা চলো, চলো, রাত হয়ে যাচ্ছে, বাবা গল্প করেই যাচ্ছে।”
বাবাকে সে-সময় কিছু বলতে পারিনি কিন্তু পরে হাল্কা একটা প্রতিশোধ নিয়েছিলাম, যদিও ইচ্ছে করে নয়। ভাবতেই হাসি পাচ্ছে এখন।
গড়িয়াহাটে গেছি পুজোর কেনাকাটা করতে। আমি আর দিদিভাই(আমার বড় জা)। সকালে বারোটা নাগাদ বেরিয়েছি। সব কাজ সেরে বাসে উঠেছি সাড়ে চারটে নাগাদ। ঘন্টাখানেক লাগবে ফিরতে।
খানিক এসেই বাস আর নড়ে না। উর্রে জ্যাম! তখনো মোবাইল নেই। ফলে, বাড়িতে খবর দেবার প্রশ্নই নেই। বাড়িতে চিন্তা করবে ভেবে বিচলিত হচ্ছি আমরাও। অবশেষে সাতটার কিছু পরে বাড়ি ঢুকলাম।
বাবা কাজের ঘরে ছিলেন। মা খবর দিলেন আমরা ফিরেছি। বাবা উঠে এলেন। চোখের দৃষ্টি প্রখর, গলা আরো গম্ভীর।
– তোমাদের ব্যাপার কী? এত দেরি? সেই কখন বেরিয়েছ দুটিতে… চিন্তা হয় না বুঝি?
একটু রাগ হল। কিন্তু বাবাকে রাগ দেখানোর কথা ভাবতেই পারতাম না। তাই উলটো রাস্তায় হাঁটলাম। হেসে হেসে বললাম, “সাড়ে পাঁচটার ভেতরেই চলে আসার কথা। অসম্ভব জ্যাম রাস্তায়। কিসের যেন মিছিল বেরিয়েছে। তাছাড়া, সবে তো সন্ধে, রাত দেড়টা বাজলে নয় চিন্তার কারণ হতে পারত, তাই না বাবা?”
বাবা বুঝে গেলেন লুজ বল দিয়েছেন। আর একটাও কথা বললেন না। চলে গেলেন কাজের ঘরে। মা খুব খুশি হলেন। বললেন, “ঠিক করেছিস বলে। নিজেরা গল্প করে রাত দেড়টা বাজাবে তার বেলা?” দিদিভাই বলল, “তোর কি অসীম সাহস!”
একথা ঠিকই, অন্য কেউ একথা বললে হয়ত বাবা রেগে যেতেন কিন্তু আমাকে একটু বেশিই স্নেহ করতেন বলে ছাড় পেয়ে যেতাম।
অনাড়ম্বর জীবনযাপন ছিল বাবার সে কথা আগেই বলেছি। ওঁর জন্মদিনে আমরা চাইলেও কোন অনুষ্ঠান করতে দিতেন না। বাড়িতে রান্না ভালোমন্দ খাবারেই খুব সন্তুষ্ট হতেন।
সত্যি কথা বলতে কী, ঘটা করে জন্মদিন পালনের কোন ধারণাই এই বাড়িতে ছিল না। জন্মদিন মানে এঁদের কাছে পায়েস, মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, আলুপোস্ত, ধনেপাতার বড়া বা কুমড়ো অথবা বক ফুলের মরসুম হলে তো কথাই নেই, মুচমুচে ভাজা সঙ্গে মটন। পায়েস মাস্ট আর সন্তোষের মিষ্টির দোকানের লাল দই।
আমি আবার খুব ছোট্ট করে হলেও জন্মদিন পালনে অভ্যস্ত। আমার জন্মদিনে বন্ধুরা, মাসি-পিসি, কাকু, জেঠু সব আসত। বেশি আনন্দ অবশ্যই ছিল উপহার পাওয়ার ( এই বাড়তি কথাটুকু বলার লোভ সামলাতে পারলাম না)। তাই এই বাড়িতে আসার পর জন্মদিনের একটা রেওয়াজ চালু করেছিলাম। বাবা কিন্তু কক্ষণও আপত্তি করেননি। কেবল নিজের জন্মদিনটুকু ওই খাওয়া দাওয়াতেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। এবার একটা গল্প শোন।
সেটা ১৯৯১ সাল। ত্রিদিবের ঠাকুর্দা স্বর্গীয় অবনীভূষণ চট্টোপাধ্যায়ের শততম জন্ম বছর। ২রা সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। বাবা হঠাৎ বললেন, “বাবার জন্মদিন পালন করলে হয় না?” আমরা তো বেজায় খুশি; সঙ্গে কিছুটা অবাকও বটে। বাবা বলছেন জন্মদিন পালনের কথা! বলেছেন যখন তখন আর দেরি নয়– শুরু হয়ে গেল তোড়জোড়।
আত্মীয় এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা এলেন। হইহই করে কাটল সারা সন্ধে। খুব আনন্দ করল সাব্বাই। বাবার চোখেও এক অদ্ভুত তৃপ্তির আমেজ ফুটে উঠতে দেখেছিলাম। বুঝলাম, অতিরিক্ত কিছু না করে জন্মদিন পালনের ব্যাপারটা বাবার ভালো লেগেছে। বাবার গ্রহণক্ষমতা ছিল অপরিসীম। একবারও বলেননি, “জন্মদিন পালন মানে টাকার অপচয়।”
বাড়ির বা ব্যাবসা সংক্রান্ত কোন সমস্যা হলে বাবা যেমন আলোচনা করতেন, কোনটা করা উচিত বা উচিত নয় সেই পরামর্শ দিতেন, আত্মীয় বন্ধুদের তো বটেই এমনকি অচেনা মানুষও যদি কোনভাবে তাঁর কাছে কোন সমস্যা নিয়ে আসত, তিনি ততটা সময় ধরেই তার সঙ্গে কথা বলতেন। বাবার পরামর্শমত চলে উপকৃত হয়েছে বহু মানুষ।
একমাত্র জর্দা পান খাওয়া ছাড়া বাবার আর কোন বিলাসিতা ছিল না। জর্দা পাতা এনে নানান মশলা মিশিয়ে বাড়িতেই তৈরি হত জর্দা। গন্ধে ভুরভুর করত সারা বাড়ি।
আমি যখন বাবাকে দেখেছি তখন ওঁর বাঁধানো দাঁত। গোটা পান চিবোনো মুশকিল। তাই পান সাজা থাকত, বাবা যখন খেতেন তখন ছোট হামানদিস্তায় ছেঁচে দিত সেই পান। কে দিত? দিত ঘনশ্যামদা। বাবার যাবতীয় দেখাশোনা ঘনশ্যামদাই করত।
বাবা ডাক দিতেন, “ ঘনা- আ…”
অমনি নিমেষে হাজির হত ঘনশ্যামদা। এক পায়ে খাড়া বাবার নির্দেশ পালন করার জন্য।
অনেক কাজ বাবা শেষ করে যেতে পারেননি চোখের সমস্যার জন্য। দু’দুবার রেটিনা ডিট্যাচমেন্ট হওয়াতে খুবই অসুবিধে ছিল। দুরন্ত ঈগলের মতো আরো কয়েকটা কালজয়ী উপন্যাস আমরা পেতাম নাহলে।
আবারো একটা মজার কথা মনে এল। বলছি।
ত্রিদিবের জামাইবাবু বড় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তাও আবার বিলেতফেরত। এখন যেমন বিলেতফেরত বললে ওপাড়া ফেরত মনে হয়, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে তা ছিল না। তখন বিলেতফেরত মানুষকে আলাদা সম্ভ্রমের চোখে দেখা হত।
জামাইবাবু দু’হাতের আঙুলে বেশ কয়েকটা পাথরের আংটি ছিল। বাবা এই নিয়ে খুব মজা করতেন। বলতেন, “বিজ্ঞান পড়েছ বটে কিন্তু ভরসা সেই পাথরে। কি আশ্চর্য!”
জামাইবাবু কম কথার মানুষ ছিলেন। তিনি শ্বশুরমশাইকে বোঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন, “শুনুন, রঙের একটা এফেক্ট যে শরীরের ওপর আছে সেটা মানেন তো? এই রঙিন পাথর ভেদ করে সূর্যের আলো যখন শরীরে ঢোকে তখন…”
বাবা হাহা করে হেসে উঠে বলতেন, “আরে রাখো তোমার সূর্যের পাথর-ভ্রমণ। ওসব ভন্ড জ্যোতিষীদের পাথর বিক্রি করার ধান্দা। আমারো একটা কুষ্ঠি আছে তোমার শাশুড়িমায়ের জিম্মায়। পারলে দেখো। তাতে তো আমার আয়ু লেখা চৌষট্টি বছর। কী সব তাবিজ কবচ পাথরগুষ্টি ধারণের কথা লেখা আছে। তা, আমি তো কিছুই পরিনি। এখন আমার বয়েস একাত্তর। তাহলে কি বলতে চাও আমি প্রেতাত্মা?”
জামাইবাবু অপ্রস্তুত। কোনরকমে বাবার সামনে থেকে পালাতে পারলে বাঁচেন। আর বাবা তখন বাড়ি কাঁপিয়ে হাসছেন। আমাকেও দু’একবার এই কুষ্ঠিতে লেখা বয়েসের কথা বলেছেন বাবা। এসবের যে কোন যুক্তি নেই, বলার উদ্দেশ্য সেটাই ছিল।
মানুষ মরণশীল। আমরা কেউই চিরকাল থাকব না। বাবাও চলে গেলেন ১৯৯৫ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি। জানুয়ারির ২৭ তারিখে আটাত্তর পূর্ণ করেছিলেন। সব মৃত্যুই কষ্টের। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু এমন একটা ফাঁকা জায়গা রেখে যায় যা আর ভরাট হয় না। হিমালয় পর্বত যদি কাল না থাকে তাহলে? বাবার চলে যাওয়াও আমাদের কাছে তেমনই।
বাবা কেমন ছিলেন তার সবটা হয়তো তুলে ধরতে পারলাম না কিন্তু লিখতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে মাথায় তাঁর হাতের স্পর্শ পেলাম। আজ শেষ করলাম। আবার কখনো বলব কিছু যদি বলার মতো মনে পড়ে।
(আমরাও আরো গল্প শোনবার আশায় রইলাম—সম্পাদক)
গ্রাফিক্স্ঃ ইন্দ্রশেখর
খুব ভালো লাগলো।
LikeLike
খুব ভালো লাগল পড়ে।
LikeLike