পুষ্পেন মণ্ডল
আজকে এমন একজন বিস্মৃত বাঙালি ডাক্তারের কথা তোমাদের বলব যাঁকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানির ‘কোল্ডিজ’ ক্যাসেলে যুদ্ধবন্দি করে রেখেছিল নাৎসিরা। বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার। তিনি নাকি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে মুখের উপর ‘না’ বলেছিলেন। বলেছিলেন, “আপনার কাছে পথ খোলা ছিল। আপনি আই.এ.এস. পাস করেও ইস্তফা দিয়ে চলে এসেছিলেন দেশের কাজ করার জন্য। আমি পারিনি। আমি কথা দিয়েছি আমার পিতাকে, আমার পরিবারকে। আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ইংরেজ সরকারের কাছে। তাই তাদের সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।”
অনেক অনুরোধ ও লোভ জার্মানরা দেখিয়েছিল বন্দি ক্যাপ্টেন ডাক্তার বীরেন্দ্রনাথ মজুমদারকে। কিন্তু তাঁকে কিছুতেই টলানো যায়নি। কিছুতেই নেতাজির বাহিনীতে যোগ দেননি তিনি। তোমরা ভাববে, সারা দেশ যখন বিদ্রোহের আগুনে জ্বলছে, নেতাজি নিজের জীবন বাজি রেখে আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি করছেন দেশকে স্বাধীন করার জন্য, সে সময়ে তাঁর পাশে না দাঁড়ানো মানে নিশ্চয়ই তিনি দেশকে ভালোবাসেন না। তিনি কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন নিজের মাতৃভূমির সঙ্গে?
না। তিনি নিজের দেশকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। কিন্তু সুদূর ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওয়ারফিল্ডে ইংরেজরা তাঁকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছিল, সেটাকে উপেক্ষা করে, কর্তব্যকে ঠেলে সরিয়ে তিনি জার্মানদের সমর্থন করতে পারেননি। তাই মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি চিৎকার করে নাৎসিদের বলেছিলেন “আমার সঙ্গে তোমরা যা খুশি করো, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না।”
বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাস করে লণ্ডন পাড়ি দেন চাকরির খোঁজে। যোগ দিলেন ‘রয়্যাল আর্মি ম্যাডিক্যাল টিমে’। সেই সময়ে ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করল। আর তারপরেই শুরু হয়ে গেল সারা ইউরোপ জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফ্রান্স আর ব্রিটেন যুদ্ধ ঘোষণা করল জার্মানির বিরুদ্ধে। আর এই যুদ্ধের আবহাওয়াতেই বীরেন্দ্রনাথ মজুমদারকে জেনারেল মেডিক্যাল অফিসারের পোস্টে পাঠানো হল ফ্রান্সের ইটাপেলস হসপিটালে। সেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্যদের শুশ্রূষা করাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ।
১৯৪০ সালে কিছু গুরুত্বর আহত সৈন্যদের নিয়ে তিনি পাঁচ ছ’টা এ্যাম্বুলেন্সে করে ইটাপেলস থেকে মাত্র তিরিশ কিলোমিটার দূরে ফান্সেরই আর এক সমুদ্র শহর বুলুগন যাচ্ছিলেন আরও ভালো চিকিৎসার জন্য। পথে আচমকা ঘিরে ধরে জার্মান ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট। শুরু হয় এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ। বীরেন্দ্রনাথ জার্মান লেফটেন্যান্টকে অনুরোধ করেন, এ্যাম্বুলেন্সে আহত মানুষ আছেন, ওনাদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু জার্মানরা সবাইকে যুদ্ধবন্দি করে। বীরেন্দ্রনাথ বাধ্য হন আত্মসমর্পণ করতে।
তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া হল জোর করে। দিনের পর দিন হাঁটা। পথে না দেওয়া হল খাবার, না দেওয়া হল জল। বাথরুম যাওয়ার জন্যও অনুমতি নিতে হত। প্রায় একশ কিলোমিটার রাস্তা তাঁদের পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এইভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বীরেন্দ্রনাথের বেশ কয়েকজন অসুস্থ সঙ্গী মারা যান পথেই।
জার্মানির সীমান্ত পেরিয়ে তাঁদের স্থানান্তরিত করা হয় একটি যুদ্ধবন্দিদের ক্যাম্পে। সেখানে বীরেন্দ্রনাথ ছিলেন একমাত্র অসামরিক ব্যক্তি। অসহ্য অত্যাচার সহ্য করেছেন দিনের পর দিন। তাঁদের চোখের সামনে নাৎসি বাহিনী ভালো ভালো খাবার খেত। দৈবাৎ বন্দিদের কপালে জুটত বাসি রুটি আর কালো কফি।
সেই ক্যাম্পে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে শুরু হল এক চর্মরোগ। যার থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য জার্মানরা প্রত্যেক বন্দির গায়ের লোম আর মাথার চুল কামিয়ে দিতে শুরু করল। কিন্তু বীরেন্দ্রনাথ তীব্র প্রতিবাদ করে বললেন, “আমাকে মেরে ফেল, কিন্তু মাথার চুল আমি কামাব না। এক মাত্র বাবা-মা মারা গেলেই আমরা মাথার চুল ফেলি।”
এরপর সেই বন্দি শিবিরের কমান্ডার একদিন বীরেন্দ্রনাথকে ডেকে প্রস্তাব দিল, যে তিনি যদি তাঁর দেশের বিপ্লবীদের সাহায্য করার জন্য রাজি থাকেন, তাহলে তাঁকে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু বীরেন্দ্রনাথের মনে জার্মানদের প্রতি ইতিপূর্বেই যে তীব্র ঘৃণা ও অনীহা তৈরি হয়েছিল, সেই কারণেই সরাসরি ‘না’ বলে দিলেন মুখের উপর। ঐ সময়ে ভারতবর্ষের বাইরে বিভিন্ন শহরে দেশকে স্বাধীন করার জন্য তৈরি হয়েছে গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন। তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে যে সমস্ত সৈন্যরা বন্দি রয়েছেন বিপক্ষ শিবিরে তাঁদের একত্রিত করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে দল গঠন করা। কিন্তু বীরেন্দ্রনাথ সেই দলে যোগ দিতে রাজি হলেন না।
এরপর জার্মানরা তাঁকে বন্দি শিবির থেকে বের করে মেরিনবার্গে নিয়ে গেল। সেখানে নাৎসিদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আবার তাঁকে একই প্রশ্ন করল। সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পদ ও অর্থের লোভ দেখাল। কিন্তু এবারও বীরেন্দ্রনাথ রাজি হলেন না। শেষে তাঁকে কোল্ডিজের দুর্গে নিয়ে গিয়ে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হল।
এদিকে ১৯৪১ সালের ১৬ই জানুয়ারি নেতাজি নিজের ভবানীপুরের বাড়িতে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গিয়ে আফগানিস্তান, পেশোয়ার, মস্কো হয়ে শেষে পৌঁছালেন বার্লিন। সারা পৃথিবী তখন পুড়ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুনে। নাৎসি বাহিনীর একছত্র অধিপতি হিটলারের সঙ্গে সমঝোতা করে ভারতের স্বাধীনতার জন্য জার্মানদের পাশে চাইলেন।
১৯৪৩ সালে বীরেন্দ্রনাথ মজুমদারকে কোল্ডিজের কারাগার থেকে বার্লিন আনা হল। তখনও তিনি জানতেন না যে নেতাজি অপেক্ষা করছেন তাঁর জন্য।
বীরেন্দ্রনাথ নেতাজির সঙ্গে বার্লিনে বসে কথা বলছেন সম্পূর্ণ বাংলায়। ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ আলোচনা করলেন নেতাজি। শেষে সুভাষচন্দ্র বললেন, “আপনি জানেন কেন আপনাকে এখানে আনা হয়েছে। আমি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য একটা দল গঠন করেছি। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন তাতে যোগ দিতে?”
বীরেন্দ্রনাথ জানালেন, “না।”
নেতাজি হয়ত এটা আশা করেননি। তিনি ভেবেছিলেন যে নিজে যদি বলেন হয়ত বীরেন্দ্রনাথ দেশের জন্য কাজ করতে রাজি হবেন। কিন্তু বীরেন্দ্রনাথ ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। তাঁর ‘না’ মানে ‘না’ই। কেউ তাঁকে এক চুল টলাতে পারেনি। হয়ত বিনা কারণে দীর্ঘ কারাবাস থেকে তাঁর মনে তীব্র জার্মান বিদ্বেষ তৈরি হয়েছিল।
ফিরে যাওয়ার আগে নেতাজি পুনরায় বীরেন্দ্রকে প্রশ্ন করলেন, “আমরা দ্বিতীয়বার আর সামনা-সামনি হব না। আমি চাই তুমি আমার সঙ্গে চল।”
বীরেন্দ্রনাথ জানালেন, “আমি আপনাকে অত্যন্ত সম্মান করি। কিন্তু আপনি যা পেরেছেন আমি তা পারব না। আপনার কাছে পথ খোলা ছিল। আপনি আই.এ.এস. পাস করেও ইস্তফা দিয়ে চলে এসেছিলেন দেশের কাজ করার জন্য। আমি পারিনি। আমি কথা দিয়েছি আমার পিতাকে। আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ইংরেজ সরকারের কাছে। তাই তাদের সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।”
তাঁকে পুনরায় কোল্ডিজ দুর্গের দুর্ভেদ্য কারাগারে নিক্ষেপ করা হল। আবার শুরু হল অন্ধকারের জীবন। সেখানে কয়েকজন বন্দি ডাচ সেনা অফিসার তাঁর বন্ধু হয়েছিলেন। তাঁরা বীরেন্দ্রকে স্মরণ করিয়ে দিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কাণ্ডারি মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের কথা। বীরেন্দ্র সেই কারাগার থেকে মুক্তির কোন উপায় না দেখে সেই পথ অনুসরণ করেই শুরু করলেন অনশন। পাঁচ সপ্তাহ তিনি শুধু জল পান করে শুয়ে থাকলেন। স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হওয়ায় বাধ্য হয়ে জার্মানরা তাঁকে অন্য একটি ভারতীয় শিবিরে স্থানান্তরিত করল।
সেখানে প্রায় সবাই ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার যুদ্ধবন্দি সাধারণ সৈনিক। নিরাপত্তার বজ্রআঁটুনিও ছিল না অতটা। বীরেন্দ্র অনশন প্রত্যাহার করলেন। কিছুদিন পর সেই বন্দিদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার আদেশ এল উপরমহল থেকে। একটি ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়ার সময় বীরেন্দ্র দুই ভারতীয় যুদ্ধবন্দি শেঠি আর সেলিমের সঙ্গে পালিয়ে গেলেন। অনেক কষ্টে একটা গ্রামে ঢুকে সংগ্রহ করলেন কিছু খাবার। তাদের কাছেই জেনেছিলেন কাছাকাছি ফ্রান্সে ঢোকার রাস্তা। তিনি জানতেন যে-ভাবেই হোক একবার ফ্রান্সে ঢুকে পড়তে পারলে ব্রিটেনে পৌঁছান অনেক সহজ হবে। কিন্তু পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে টানা পাঁচ দিন হাঁটার পর সীমান্ত পেরনোর আগেই তাঁরা ধরা পড়লেন জার্মান সেনার হাতে। ধরে নিয়ে আসার পর গেস্টাপো বীরেন্দ্রনাথকে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, তিনি কি সুভাষ বোসের দলে যোগ দিতে চান? বীরেন্দ্রনাথ এবারেও তাঁর একরোখা মনোভাব বজায় রেখে ‘না’ বললেন। এবার অন্য একটি কারাগারে পাঠান হল তাঁকে। সেখানে আগে থেকেই ইটালিতে যুদ্ধরত কিছু ভারতীয় সেনাকে রাখা হয়েছিল।
কিছুদিনের মধ্যে অন্য তিন ভারতীয়ের সঙ্গে বীরেন্দ্রনাথ আবার পরিকল্পনা করলেন কারাগার থেকে পালানোর। এবার চ্যালেঞ্জটা ছিল আরও অনেক কঠিন। সামনে ছিল ১৩ ফুট উঁচু দুর্গের পাঁচিল। সেটা অনেক কষ্টে রাতের অন্ধকারে তা পার হলেন। শুরু হল আবার অন্তহীন পথ চলা। গ্রামের এক ফরাসি বিধবা তাঁকে থাকতে দিয়েছিলেন বাড়িতে। তারপর তিনি সুইজারল্যান্ডের সীমানা পেরিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। এর কয়েকদিনের মধ্যেই ব্রিটেনের দূতাবাসের মাধ্যমে ফিরে এলেন লণ্ডনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে তত দিনে। জার্মানরা পরাজিত।
বীরেন্দ্রনাথ মজুমদারের রোমাঞ্চকর জীবন কিন্তু এখানেই শেষ হল না। তাঁকে তাঁর পরবর্তী চাকরিজীবনেও বারংবার অপদস্থ হতে হয়েছে সাদাচামড়ার ব্রিটিশদের কাছে। তাঁর কুখ্যাত জার্মানদের কাছে বন্দিদশা থেকে পালিয়ে লণ্ডনে ফেরার সত্যিকাহিনী অনেকে গল্প বলে উড়িয়ে দিয়েছে। অনেকে তাঁর পিঠে দেগে দিয়েছে নেতাজির গুপ্তচরের ছাপ। ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা এম.আই.৫ ও এম.আই.৬ তাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখে জেরা করেছে, সুভাষচন্দ্র বোসের তথ্য জানার জন্য। কেউ হয়ত বিশ্বাসই করেনি তিনি নেতাজিকে সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ‘না’ বলেছিলেন। বরং এই মতটাই ব্রিটিশ গোয়েন্দারা গ্রহণযোগ্য মনে করেছে যে, তাঁকে নেতাজিই পাঠিয়েছেন ব্রিটেনের সেনাবাহিনীতে থেকে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য। আর সে জন্যই তাঁকে নাৎসিরা সেফ প্যাসেজ দিয়েছিল পালিয়ে যাওয়ার।
আসল সত্যিটা কী ছিল? তা কেউ জানে না। বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার কি ইংরেজ ভক্ত ছিলেন? না নেতাজির গুপ্তচর? এ প্রশ্নের উত্তর তলিয়ে গেছে কালের গহ্বরে।
স্মরণীয় যাঁরা সব এপিসোড একত্রে
খুব সুখপাঠ্য ফিচার। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এল সম্পূর্ণ নতুন এক নাম, ব্যক্তিত্ব ও তাঁর জীবনের সত্যসম্বলিত ঘটনাবহুল কাহিনি। তথ্য পূর্ণ ফিচারের জন্য লেখক ও পত্রিকাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভকামনা।
LikeLike