স্মরণীয় যাঁরা-আগের পর্বগুলো
সম্প্রতি নোবেল কমিটি নোবেল পুরস্কার দিয়েছেন এমন একজন মানুষকে যিনি আসলে এক বিখ্যাত গায়ক, তিনি গান লেখেন,সুর দেন,সেইসব গান নিজেই গেয়ে শোনান পৃথিবীর নানা দেশের সঙ্গীতপ্রেমী মানুষকে। ২০১৬ সালে সাহিত্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন।
সব দেশের মানুষই অবাক এই ভেবে যে একজন সুরস্রষ্টা,গায়ক কী করে সাহিত্যে নোবেল পেলেন! আসলে তিনি একজন সার্থক গীতিকবি।তাঁর লেখা গান কবিতা হয়ে উঠেছে।এখন তাঁকে নিয়ে চলছে কত আলোচনা,তাঁর নাম উঠে এসেছে দেশ-বিদেশের খবরের কাগজের শিরোনামে।এবারের স্মরণার্ঘ্য সেই মানুষটিকে নিয়ে।
বব ডিলানের নাম কে না জানে!সারা পৃথিবীতে পপ, রক এন রোল,এসব গানের জগতে এক বিশ্বজয়ী গায়ক হিসাবে পরিচিত বব ডিলান। আমেরিকান এই শিল্পী একাধারে সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীত রচয়িতা ও গীতিকাব্য রচয়িতা। গদ্যে পদ্যে মেশানো তাঁর লেখা গানের অনেকগুলিকেই সাহিত্যের পর্যায়ে বিবেচনা করেছেন নোবেল কমিটি। এছাড়া সারা বিশ্ব গত পঞ্চাশ বছর ধরে তাঁর গানে মাতোয়ারা।
এক মিশ্রধর্মীয় পরিবারের সন্তান বব ডিলানের অন্তরে আছে এক বিশ্বজনীনতা। তাঁর বেশির ভাগ গানের ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে এক বিস্তৃত রাজনৈতিক,সামাজিক, দার্শনিক বিষয়। সেই গানের সুরের মূর্ছনার মাধ্যমেই তুলে ধরেছেন সামাজিক অন্যায়-অবিচারের কথা, সমসাময়িক আমেরিকার সমাজের অস্থিরতার কথা। সুরের মাদকতায় আবিষ্ট শ্রোতাদের মনে পৌঁছে গেছে প্রতিবাদের ভাষা। শ্রোতাদের অন্তরে সামাজিক চেতনার বীজ রোপিত হয়েছে গানের মাধ্যমে। রচনার পারদর্শিতায় তাঁর গানের লিপি সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
সদ্যপ্রাপ্ত নোবেল পুরস্কার যে তাঁকে সমাজে অনেক উঁচুতে তুলে ধরবে তা ভাবার কোন কারণ দেখি না। ইতিমধ্যেই তিনি দেশে বিদেশে নানা সম্মান, পুরস্কার পেয়েছেন। সাহিত্যিক হিসাবে বব ডিলানের এই পুরস্কারের দরকার না হলেও সাহিত্যের যেন প্রয়োজন ছিল এই পুরস্কারের। তাঁর প্রাপ্তির ঝুলিতে আছে এ পর্যন্ত এগারোটি গ্র্যামি, একটি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড, একটি গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড। পেয়েছেন রক এন রোল হল অফ ফেম, মিনেসোটা মিউজিক হল অফ ফেম, ন্যাশভিলে সং রাইটারস্ হল অফ ফেম। ২০০৮ সালে পুলিৎজার পুরস্কার কমিটিও তাঁর অসামান্য কাব্যিক রচনা ও আমেরিকান সংস্কৃতি ও লোকপ্রিয় লোকগানের উপর তাঁর অসামান্য কাজের জন্য তাঁকে পুরস্কৃত করেছেন।
তাঁর গীত রচনার বিশেষত্ব হচ্ছে বিষয়বস্তু নির্বাচন, সেই গীতের ভাষা,আর পরিবেশনের ভঙ্গিমা,তাঁকে এতখানি জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। তাঁর বিখ্যাত দু’টি গান,“ব্লোন ইন দ্য উইন্ড”ও “দ্য টাইমস দে আর আ-চেঞ্জিন”হয়ে উঠেছিল আমেরিকার সিভিল রাইট আন্দোলন ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের মন্ত্রগীত।
সচেতনভাবে সঙ্গীতজীবন শুরু করেছিলেন আমেরিকার হারিয়ে যেতে বসা লোকসঙ্গীতের পুনরুদ্ধারের জন্য। সেইসব লোকগানে নতুন সুর দিয়ে গাইতেন। এক সময়ে নিজেই গান লিখতে শুরু করলেন। তাঁর নতুন লেখা আর সুর দেওয়া সব গান, পরিবেশনার গুণে হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদী জনসঙ্গীত। ভিয়েতনামের যুদ্ধের সময়,ষাটের দশকে আমেরিকার সামাজিক অস্থিরতার সময়, মার্টিন লুথারের মিছিলে সর্বত্র তিনি প্রতিবাদের সুরের গান নিয়ে এগিয়ে চলেছেন, হেঁটেছেন যুদ্ধবিরোধী মিছিলে, প্রতিবাদী হয়েছেন, গানের কথার মাঝে মাঝে বলেছেন আমেরিকার বহুনিন্দিত দাসপ্রথার গল্প। তাঁর সব আগুনঝরানো গান শুনে বিশ্বের যুব সমাজে এসেছিল ডিলানপ্রেমের ঝড়।
কালক্রমে তাঁর সঙ্গীতধারায় এসে মিশেছে নানা ভাষার লোকসঙ্গীত। ইংরেজী, স্কটিশ, আইরিশ, আমেরিকান লোকসঙ্গীত ব্লুজ, কান্ট্রিসং, গসপেল, রক এন রোল এমনকি জ্যাজও। তাঁর সুরারোপ আর পরিবেশনার গুণে সেসব গান হয়ে উঠেছে একেবারে স্বতন্ত্র। লোকগানের প্রচলিত বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি তাঁর অর্কেস্ট্রাকে। গিটার,আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ইলেকট্রিক গিটার ব্যবহার করেছেন তাঁর সঙ্গীতের অনুসঙ্গ হিসাবে, কিন্তু প্রায় সবেরকম বাদ্যযন্ত্রেই তিনি দক্ষ ছিলেন। রেকর্ডিং-এর আধুনিক অনুসঙ্গ বা নিজের গলার স্বর শোনবার জন্য হেডফোন ব্যবহার করেননি। গানের সুরে মেলোডিটা ফোটানোর জন্য ব্যবহার করতেন হারমোনিকার মত কোমল সুরের যন্ত্র, আর নিত্যসঙ্গী গিটার।
গান নিয়ে ঘুরেছেন পৃথিবীর প্রায় সব দেশ। ভাগ্যান্বেষণে গিয়েছিলেন নিউইয়র্কে। সেখানকার জনপ্রিয় লোকগান নিয়ে শুরু করলেন তাঁর সঙ্গীতসফর। ধরতে পারলেন নিউইয়র্কের জনমানস,নিজের উত্তরণকে করলেন পাখীর চোখ,শুরু হল এক বিশ্বজয়ী মানুষের জয়যাত্রা। ১০০ লক্ষ রেকর্ড বিক্রি হয়েছে তাঁর, যা তাঁকে সর্বকালের জনপ্রিয় শিল্পীদের অন্যতম বলে প্রমাণ করেছে।
১৯৬৩ সাল থেকে তাঁর যেসব রেকর্ড বেরিয়েছিল,সেগুলির ওপর লেখা ছিল ‘প্রোটেস্ট সং’।তাঁর সঙ্গীত জীবনের আদর্শ ‘উডি গাথরি’র গানের ভাষা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল,তিনিও হয়ে উঠেছিলেন একজন মানবতাবাদি চারণকবি। গান বাঁধতেন, সুর দিতেন, সে গান নিয়ে ঘুরতেন দেশ-বিদেশ, মানুষকে সময়োপযোগী নব চেতনায় উদ্দীপিত করতেন।
তাঁর বিখ্যাত গান “ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড” তাঁকে পরিচিতি দিয়েছিল গণমুক্তি আন্দোলনের একজন পথিকৃৎ হিসাবে। নিজেকে পাল্টেছেন বারবার। প্রতিবারেই তিনি প্রকাশিত হয়েছেন নতুন আঙ্গিকের সঙ্গীত নিয়ে, নতুনতর করে পরিবেশন করেছেন তাঁর লেখা আর সুর দেওয়া নতুন গান।
এমনটিই হয়েছিল আমাদের রবি ঠাকুরের বেলায়। তিনি নিজে গাইতেন না ঠিকই,কিন্তু যে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন সেটিও ত ছিল গীতিকবিতারই বই। সেগুলি কবিতার মত করে পড়া যেত,আবৃত্তি করা যেত আবার সুর দিয়ে গাওয়াও যেত।
এবার বলি শুরুর কথা। ববের ঠাকুর্দা-ঠাকুমা থাকতেন জারের শাসনাধীন রাশিয়ার ইউক্রেন অঞ্চলে,তখন নাম ছিল ওডেসা। ১৯০৫ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য দেশ ছেড়ে আমেরিকার মিনেসোটায় চলে আসেন। এখানেই ডুলুথ অঞ্চলে ববের জন্ম ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরে। ববের লেখা থেকে জানা যায় তাঁর ঠাকুমা ছিলেন একজন কিরঘিজ(তুর্কি) জাতির মেয়ে। তাঁর দাদু-দিদিমা ছিলেন লুথেরান ইহুদি। ১৯০২ সালে তাঁরাও আমেরিকায় চলে এসেছিলেন। তাঁর বাবা-মা একটি ছোট ইহুদি কমিউনিটির সদস্য ছিলেন।
পারিবারিক নাম ছিল রবার্ট অ্যালেন জিমেরম্যান। ববের যখন ছ বছর বয়স তখন তাঁর বাবা আব্রাম জিমেরম্যান পোলিও আক্রান্ত হয়ে অকর্মণ্য হয়ে পড়লেন। বাধ্য হয়ে মা বেট্রিস বেট্টি স্টোন পরিবারের সকলকে নিয়ে তাঁর বাপের বাড়ির শহর হিবিংএ চলে আসেন। সেখানেই বেড়ে ওঠা ছোট্ট রবার্ট জিমেরম্যানের। বাড়ির কাছেই মেসাবি পর্বতশ্রেণী আর সুপিরিয়র হ্রদ। সুন্দর পরিবেশ। অসুস্থ বাবা, মা কাজে যান, সারাদিন পর বাড়ি ফেরেন শ্রান্ত হয়ে। সারাদিন ববের কাটে একা একা। নীরবতা,প্রকৃতি আর গান ছিল তাঁর সঙ্গী।
ছেলেবেলা থেকে রেডিওর গানের অনুষ্ঠানের পোকা ছিলেন বব। প্রথম দিকে শুনতেন ব্লুজ আর কান্ট্রি সং। পরে ভক্ত হয়ে উঠলেন রক এন রোলের। হিবিং হাইস্কুলে পড়বার সময় বানিয়ে ফেলেছিলেন বেশ কয়েকটি গানের দল বা ব্যান্ড। পিয়ানো আর করতালি দিয়ে সমস্বরে সেই গানের গুঁতোয় সারা স্কুলের লেখাপড়া মাথায় ওঠে আরকি! বাধ্য হয়ে প্রিন্সিপাল মাইক্রোফোনের তার কেটে দিলেন।
১৯৫৯ সালে, ১৮বছর বয়সী বব চলে গেলেন মিনিয়াপোলিসে,ভর্তি হলেন ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটায়। এখানে এসে রক এন রোলের গানের ওপর থেকে ঝোঁক চলে গেল। আগ্রহ বাড়ল আমেরিকান ফোক মিউজিক বা লোকসংঙ্গীতের দিকে। কিছুদিনের মধ্যেই কলেজ ছাড়লেন, পাকাপাকিভাবে গানের জগতে নিমগ্ন হলেন। চলে গেলেন নিউ ইয়র্ক। নাম নিলেন বব ডিলান, নিজের অণুপ্রেরণাদাতা কবি ‘ডিলান থমাস’এর নামে।
বংশগত বিশ্বজনীনতা ছিল তাঁর মধ্যে। জীবনেও তিনি ছিলেন তাই। কখনো মেনে চলেছেন পৈতৃক ধর্ম জুডাইজম,কখনও খ্রিস্টধর্ম ।সব নিপীড়িত মানুষের প্রতিবাদের স্বর ধ্বনিত হয়েছে তাঁর গানে।
তিনি এমন একজন মানুষ যাঁর জীবিত অবস্থাতেই তাঁর ১৬টি জীবনী লেখা হয়েছে,তাঁর গান ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে প্রায় ৫০টি বই। তিনি নিজে আর্ট বুক লিখেছেন ৫টি, আর ১৯৭১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে গানের ওপর বই লিখেছেন ৬টি। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা বিখ্যাত বই হচ্ছে ‘ট্যারেন্টুলা’,না কোনও মাকড়সাকে নিয়ে লেখা নয়। এটি গদ্য ও পদ্য মিশিয়ে লেখা এক উপন্যাস।
১৯৫২ থেকে তাঁর সঙ্গীত জীবনের যাত্রা শুরু লোকসঙ্গীতের গায়ক হিসাবে।
এই সময়ে ব্রিটেনে বিটলস্দের রমরমা।১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে লিভারপুলের বাসিন্দা ষোলো বছরের কিশোর জন লেননের ইচ্ছায় যে গানের দল বা ব্যান্ড তৈরি হয়েছিল,তাতে ছিলেন চার কিশোর।১৭বছর বয়সী রিদম গিটারবাদক পল ম্যাককার্টনি,যাঁর ছিল অসামান্য গান লেখার ক্ষমতা।ছিলেন চোদ্দ বছর বয়সী লিড গিটারবাদক জর্জ হ্যারিসন,আর ছিলেন রিঙ্গো স্টার।১৯৬০ সাল থেকে এই লিভারপুল রক ব্যান্ড নিজেদের গান নিয়ে মাতাচ্ছিল ইংল্যান্ডের শ্রোতাদের,যাদের বিরাট অংশই ছিল টিনএজার।স্ক্রিফল্ গান দিয়ে শুরু করে এই ব্যান্ড নানা ধারার গান নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিল-পপ,ব্যালাড, রক এন রোল,ইন্ডিয়ান মিউজিক থেকে সাইকোডেলিয়া (মন বা আত্মা নিয়ে লেখা নানা গান)সব রকম গান নিয়ে চলছিল তাঁদের নানা প্রচেষ্টা।সেইসব গান নিয়েই চলছিল ক্লাবে ক্লাবে তাঁদের অনুষ্ঠান।নানা ধ্রুপদী বিষয়কেও অপ্রচলিত অর্কেষ্ট্রার সঙ্গে পরিবেশন করতেন নির্দ্বিধায়।চির পরিচিত ধারার বাইরে গিয়ে চলত তাঁদের রেকর্ডিং পদ্ধতি।তবে সব ক্ষেত্রেই এক অভিনবত্বের ছোঁয়া থাকত।১৯৬০ সাল থেকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে এলো তাঁদের এই ব্যাণ্ড । নাম হল বিটলস্। তাঁদের গানের মাদকতায় ভাসতে লাগলো ব্রিটেনের তরুণদল,এই পাগল করা মানসিকতার নাম হল, ‘বিটলস্ম্যানিয়া’।অল্পবয়সী সঙ্গীত রচনাকারদের রচিত গানগুলি ছিল বাস্তবধর্মী,কিন্তু তারুণ্যের চঞ্চলতায় আবিল।প্রথমে ক্লাবে ক্লাবে গাইতেন তাঁরা। প্রথমে লিভারপুল,তারপরে হামবুর্গ শহরকে মাতালেন তাঁদের মিউজিক্যাল অর্কেষ্ট্রায়।
তাঁদের জনপ্রিয়তাকে অবলম্বন করলেন ব্রায়ান এপস্টেইম,হলেন দলের ম্যনেজার।প্রোডিউসার হিসাবে এগিয়ে এলেন জর্জ মার্টিন।তাঁর তত্বাবধানে তিনি রেকর্ডিং করতে শুরু করলেন বিটলস্দের গান।১৯৬২ সালে রেকর্ড করা প্রথম গান, “লাভ উই ডু”,ব্যাপক হিট হল,চার মহারথী পরিচিত হলেন ‘ফ্যাব ফোর’নামে। সমগ্র ব্রিটেন আক্রান্ত বিটলস্ম্যানিয়ায়। “আই ওয়ান্ট টু হোল্ড ইওর হ্যান্ড” গানের অ্যালবামের কারণে,১৯৬৪ সালেই তাঁরা হয়ে উঠলেন আন্তর্জাতিক তারকা।দ্য টাইমস্ পত্রিকার মিউজিক ক্রিটিক, সঙ্গীত রচয়িতা হিসাবে লেনন আর ম্যাককার্টনিকে “আউটস্ট্যান্ডিং ইংলিশ কম্পোজার”ঘোষণা করলেন।অনুষ্ঠানের ডাক এল আমেরিকা থেকে।আমেরিকার পপ সঙ্গীতের জগতে হানা দিল ব্রিটেনের সঙ্গীত।সংবাদপত্র এই অভিযানের নাম দিল ‘ব্রিটিশ ইনভেশন’।
১৯৬৪ সালের ২৮শে আগস্ট।আমেরিকার মানহাটানের এক মিউজিক কনসার্টের আসরে রক সঙ্গীতের জগতের এক স্তম্ভ বিটলস্এর অনুষ্ঠান। সেখানেই দর্শকাসনে আমেরিকান রক সঙ্গীত জগতের আরেক প্রবাদপ্রতিম স্তম্ভ বব ডিলান উপস্থিত। কনসার্টের শেষে, রাতে দেখা হল বব ডিলানের সঙ্গে বিটলস্ গায়কদের, নিউইয়র্কের মানহাটানের ডেলমোনিকো হোটেলের এক স্যুইটে।ববের সঙ্গে ছিলেন সাংবাদিক আল-আরোনোউইটজ্।সে এক স্মরণীয় কাল সন্ধিক্ষণ।এই সাক্ষাৎকার রক-পপ সঙ্গীতের ধারাবাহিক নিয়মের জগতে এক নতুন ধারার জন্ম দিল।বিটলসে্র চিন্তাধারার জন্মান্তর ঘটল সেই সাক্ষাৎকারের ফলে। মনে হল লিভারপুলের বিটলসদের কাছ থেকে আরও কিছু বেশী আশা রাখেন প্রতিবাদী, সমাজসচেতন গায়ক, কাকতাড়ুয়া চেহারার ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা বব ডিলান। একসাথে বসে উদ্দীপনার ধুম পান করলেন তাঁরা। বিখ্যাতদের মধ্যে যেমন প্রচ্ছন্ন থাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা বিরোধের, প্রতিযোগিতার মনোভাব তা তো খানিকটা ছিলই নিশ্চয়। সাক্ষাতের শেষটা খুব মধুময় ছিল না। কিন্তু বিটলস্রা অনুভব করলেন অনেক কিছু, যা পরবর্তী কয়েক বছরে তাঁদের অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেল। বিটলস্দের জীবনপথে, চিন্তাধারায় এল যুগান্তকারী পরিবর্তন।
এই সাক্ষাৎকারের যে সাঙ্গীতিক আর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ছিল তা বোঝা গেল বিটলস্দের সঙ্গীতধারার পরিবর্তনে। এক ধাক্কায় বিটলসরা নিজেদের অন্তরের গভীরে খোঁজ চালালেন কোথায় তাঁদের খাম্তি।ব্যক্তিজীবনের হৃদয়মন্থন করে লিখতে লাগলেন সব নতুন গান।দুই ঘরাণার সঙ্গীতের ভক্তদের মধ্যেকার বিস্তর ফারাকটা নজরে পড়ল তাঁদের। বিটলস্রা লক্ষ করলেন, বব ডিলানের দর্শকরা সব কলেজপড়ূয়া, বুদ্ধিমান, শিল্পবোদ্ধা। তাই বব ডিলানের গান তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতার বীজ বপন করতে পেরেছে। শ্রোতাদের অন্তরে আদর্শবাদের ধারণা আর প্রতিবাদের ভাষা সৃষ্টির চেতনা সৃষ্টি করেছিল বব ডিলানের গান।তাঁর গান শুধুই নিছক আনন্দ দানের গান ছিল না।সেগুলির মধ্যে ছিল জনমত তৈরি করার মত উপাদান। অন্যদিকে বিটলস্দের নিজেদের গানের শ্রোতাদের বেশিরভাগটাই ছিল তারুণ্যের উল্লাসে,উদ্দীপনায় ভরপুর স্কুল বা হাইস্কুল পড়ুয়ার দল। শুরুতে এদের জীবন ছিল পরিবারের ছত্রচ্ছায়ার সুখলালিত,টিভি,রেডিও,পপরেকর্ড,ফ্যাশন ম্যাগাজিন,টিন এজ ফ্যাশন আর প্রাচুর্যের আনন্দ দিয়ে ঘেরা। এক চালু বাণিজ্যিক সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল তাদের জীবন। সামাজিক, রাজনৈতিক চাপানউতোরে দেশ-বিদেশের মানুষের খারাপ অবস্থা,অত্যাচার,অবিচারের কোন খবরই তারা রাখত না,তাই বুঝতও না। সে মন তৈরি করার মত কিছু ছিল না তাদের হাতের কাছে।
এই সাক্ষাৎকারের ছয়মাসের মধ্যে বিটলস্দের সঙ্গীত রচনার ধারা,ভাষা,শব্দচয়ন,প্রকাশভঙ্গী,আর উপস্থাপনায় এল এক আমূল পরিবর্তন। গীতিকার লেননের কণ্ঠস্বরে ও সুরে খানিকটা হলেও পড়ল বব ডিলানের ছায়া। ম্যাককার্টনির লেখায় এল বৈদগ্ধ।তাঁদের এক শৈল্পিক চেতনাবোধের জন্ম হল,যা তাঁদের অনেক পরিণত গীতিকার আর সুরকার করে তুলল। এরপর থেকে এক নতুন পরিণত বিটলস্দের দেখল দুনিয়া-যা এনে দিল তাঁদের ঝুলিতে একের পর এক বিখ্যাত পুরস্কার আর অনন্য পরিচিতি।
অন্যদিকে বব ডিলানের পথ চলা শুরু হল পাঁচ জন বাদকের দল আর ফেন্ডার স্ট্রাটোক্যাস্টার ইলেকট্রিক গিটার নিয়ে ।এক ঝটকায় ট্রাডিশনাল ফোক মিউজিশিয়ানের তকমা ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলে নতুন গান নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। ফোক আর রকের শ্রোতাদের পার্থক্য দূর হতে লাগল। বিটলস্ আর বব ডিলানের গানে গানে পরিপুষ্ট হল বিশ্বের রক-পপ-ফোক সঙ্গীত শ্রোতৃসমাজ।
১৯৬৪ থেকে বব ডিলান শুরু করলেন নতুন ধারার ফোক-রক-পপ মিউজিক নিয়ে অনুষ্ঠান। ১৯৭১ সালের বাংলা দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় উদ্বাস্তু মানুষদের সহায়তার জন্য পয়লা আগস্ট ম্যাডিসন পার্কে আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ হয়ে উঠেছিল সমকালীন যুদ্ধবিরোধী মানুষদের এক মিলনমেলা। সেখানে গিটার হাতে ৩০ বছরের এক বাউন্ডুলে চেহারার যুবক ৪০ হাজার দর্শককে মজিয়েছিলেন ১০ মিনিটে লেখা একটি গান গেয়ে। তাঁর গাওয়া অনেকগুলি গানের মধ্যে তাঁর বিখ্যাত সেই গান,‘ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড’ হয়ে উঠেছিল নাগরিকের অধিকার আন্দোলনের মূল গান। তাঁর ট্রেডমার্ক হয়ে উঠেছিল গলায় ঝোলানো হারমোনিকা আর হাতে একটি গিটার।
শ্রদ্ধা জানাই এই ৭৫ বছর বয়সী এই বিশ্ববরেণ্য লোকপ্রিয় মানুষটিকে যিনি আজও সমান ভাবে কাজ করে চলেছেন অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে।
বব ডিলানের মত একজন মানুষ আমাদের দেশেও ছিলেন। বব ডিলানের মতই সাধারণ এক পরিবারের সন্তান। একাধারে কবি, সঙ্গীত রচয়িতা, সুরকার, বিদ্রোহের কবিতা ও গান রচয়িতা, যুদ্ধক্ষেত্রে সেপাই হিসাবে যুদ্ধ করা, বিপ্লবী, সাংবাদিক, রুশ বিপ্লবের সমর্থক, যুদ্ধবিরোধী আর শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক বিপ্লবী কবি ছিলেন। যাঁর অগ্নিঝরা বিপ্লবী গান, কবিতা আর প্রবন্ধ ইংরেজ শাসকদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ব্রিটিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কারণে। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী,বিশ্বমানবের স্বাধীনতার পিয়াসী এই মানুষটির কবিমানস ছিল ডিলানের মতই আন্তর্জাতিকতায় ভাস্বর।
তিনি ‘কারার ওই লৌহকপাট’ ভাঙার ডাক দেয়ার গীতিকার কবি নজরুল। ইংরেজের শত অত্যাচার তাঁকে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখার আর সাম্রাজ্যবাদি শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথ থেকে সরাতে পারেনি। আন্দামান ও ভারতের বিপ্লবী বন্দিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে জেলে বসেই অনশন করেছিলেন ৩৯ দিন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে অনশন প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন, “গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক,আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস্ ইউ”। যদিও শাসকের তৎপরতায় সেটি কবির হাতে পৌঁছোয়নি। তাঁর ভাগ্য ছিল খারাপ কারণ তিনি ছিলেন পরাধীন ভারতের সন্তান। প্রতিবাদী বব ডিলানকে আমেরিকা যে সম্মান দিয়েছে,এই বাংলামায়ের সেই সন্তানের সব গুণগুলি থাকতেও তিনি পাননি কোন এতবড় সম্মান,মর্যাদা। তাই এই সুযোগে তাঁকেও একটু সম্মান জানালাম।
উমা ভট্টাচার্য র সব লেখা একত্রে