স্মরণীয় যাঁরা সব এপিসোড একত্রে
খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বেনারসের এক পন্ডিতের মেধার কথা ছড়িয়ে পড়ল জনমানসে। কাশ্মীরে জন্ম নেওয়া এই পন্ডিত তাত্ত্বিক রাজনীতি কিংবা কূটনীতিতে সমূহ পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।
এদিকে মহিলারোপ্য নগরে তখন ছিল রাজা সুদর্শনের রাজত্ব। রাজা ছিলেন বিদ্যানুরাগী ও সুশাসক। তাঁর ছিল তিন পুত্র। বাহুশক্তি, উগ্রশক্তি ও অন্ত্যশক্তি। রাজপুত্রেরা ছিলেন বুদ্ধিহীন ও বিদ্যাশিক্ষায় একেবারেই অনাগ্রহী। রাজামশায়ের মনে তাঁর মৃত্যুর পরে রাজকুমারদের পরিনতি নিয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিল। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ রাজপরিষদদের কাছে উনি একটা সমাধানের উপায় চাইলেন। নানা উপদেশ ধেয়ে এল যার বেশিরভাগই কোনো সমাধানের পথ দিল না ওনাকে। কিন্তু সুমতি বলে এক রাজপরিষদ বলে উঠলেন, ‘মহারাজ, বিজ্ঞান… রাজনীতি কিংবা কূটনীতি হল অসীম জ্ঞানের সাগর। সারা জীবন লেগে যাবে তা আয়ত্ত করতে। রাজকুমারেরা যখন বইপত্র পড়তে আগ্রহী নয়, তখন এমন কোনো গুরুমশায় দরকার যিনি বইপত্রের পড়াশোনায় না গিয়ে রাজকুমারদের মনের মধ্যে ইতিমধ্যেই জমে থাকা নানা ভাবনাকে বুঝে সরল ভাষায় জ্ঞান দান করবেন।’
কথাটা মনে ধরল রাজার। মহারাজের কানে ইতিমধ্যেই বিষ্ণু শর্মা নামক পন্ডিতে মানুষটির শিক্ষকতার গুণ ও পান্ডিত্যের কথা এসে পৌঁছেছিল। আমন্ত্রণ জানানো হল বিষ্ণু শর্মাকে। উনি তখন আশি বছরের বৃদ্ধ। তাও বিদ্যাচর্চায় বিরাম নেই। রাজামশায় অনুরোধ জানালেন, বিষ্ণু শর্মা যদি রাজবংশের যুবরাজদের রাজনীতিতে কূটনীতির জটিল পাঠ সহজ উদাহরণের মাধ্যমে জলের মত সোজা করে বুঝিয়ে দিতে পারেন তাহলে একশত গ্রাম ও প্রচুর সোনাদানা উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া হবে। বিষ্ণু শর্মা বিরক্ত হয়ে এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। উনি বিদ্যাকে বিক্রি করার মানুষই নন।
তবে রাজার এই অনুরোধ ওঁর ছিল নতুন একটা ভাবনা উদ্রেককারী। উনি বুঝতে পেরেছিলেন তিন রাজকুমারকে প্রচলিত পথে শিক্ষাদান করতে কিছুতেই পারবেন না উনি। তাই নতুন কিছু ভাবতে হবে। রাজা সুদর্শনের অনুরোধ গ্রহন করলেন বিষ্ণু শর্মা, কোনো রকমের পুরস্কারের শর্ত ছাড়াই। বললেন, ছয় মাসের মধ্যে রাজকুমারদের সিংহাসনের উপযোগী করে তুলবেন। রাজনীতির নানা পাঠ গল্পের ছলে লিখতে শুরু করলেন । রাজকুমারদের মনে গড়ে তুলতে লাগলেন কল্পনার জগত। ছাঁচ বাঁধা লেখাপড়ার গন্ধ না পেয়ে রাজকুমারেরাও আগ্রহী হয়ে উঠছিল বিষ্ণু শর্মার শিক্ষাদানে। পশু পাখীদের নানা চরিত্র হিসেবে বর্ণনা করে ছোট ছোট গল্পের আকারে উনি বুঝিয়ে যেতে লাগলেন কূটনীতি, রাজনীতি, সম্পর্ক আর প্রশাসনের নানা পাঠ। জন্ম হল ভারতবর্ষের সর্বকালের সেরা এক উপকথার। এই ইতিহাস প্রসিদ্ধ আখ্যানের নামই পঞ্চ-তন্ত্র। এই পঞ্চতন্ত্রের শিক্ষায় আলোকিত হয়ে মহিলারোপ্য নগরের তিন রাজকুমার রাজনীতি ও কূটনীতিতে হয়ে উঠলেন জ্ঞানী ও প্রশাসনে পারদর্শী। মহারাজ সুদর্শনকে চিরজীবনের মত কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ করে বিষ্ণু শর্মা বেরিয়ে পড়লেন নতুন জ্ঞানের সন্ধানে।
এদিকে এই পঞ্চতন্ত্র এদেশের সীমা ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়ে সর্বকালের অন্যতম সেরা একটি বোধিমূলক উপকথা হিসেবে নিজের মান আদায় করে নিল। বিষ্ণু শর্মা বেঁচে রইলেন তাঁর এই অমর সৃষ্টিতে।