যোগেন্দ্রনাথ সেন
পুষ্পেন মণ্ডল
ইতিহাসে এঁকে খুঁজে পাওয়া যায় ‘জন সেন’ নামে। হয়ত সে আমলে ‘যোগেন্দ্রনাথ’ কথাটা ভালো করে উচ্চারণই করতে পারত না ব্রিটিশরা। তাই এই নামকরণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শহীদ সেই বীর বাঙালি যোদ্ধা যোগেন্দ্রনাথ সেন ওরফে জন সেনের কথা আজকে শোনাব তোমাদের।
চন্দননগরের তৎকালিক এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৮৮৭ সালে জন্ম হয়েছিল তাঁর। পিতার নাম সারদাচরণ সেন। ১৯০০ সালে চন্দননগরের ‘সেন্ট মেরি স্কুল’, যার এখনকার নাম ‘কানাইলাল বিদ্যামন্দির’, থেকে এনট্রান্স ও দু’বছর পর এফ.এ. পাশ করে কলকাতার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন ১৯০৩এ। এরপর অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এডুকেশনের কাছ থেকে বৃত্তি পেয়ে ১৯১০ সালের জুলাই মাসে গোলকুণ্ডা জাহাজে আউটট্রাম ঘাট থেকে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন।
বিদেশে গিয়ে লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। পাশ করার পর ইলেক্ট্রিসিটি বিভাগে চাকরিও পান। থাকতেন লিডসে ‘ব্ল্যাকম্যান’ লেনে ‘গ্রসভেনর’ প্যালেসে। আর সেই সময়েই ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজে।
ভেতো বাঙালির মত নিশ্চিন্ত চাকরি আঁকড়ে পড়ে থাকেননি তিনি। নেমে পড়েন যুদ্ধের ময়দানে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অফিসার পদে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদনও করেন। কিন্তু আবেদন নামঞ্জুর হয়। কারণ সেই সময়ে কোন ভারতীয়কে অফিসার পদে নিয়োগ করা হত না। আশ্চর্য মনোবলে যোগেন্দ্রনাথ দমে যাননি। বরং সাধারণ সৈনিক হিসাবেই যোগ দিলেন যুদ্ধে। ১৫নং ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টে তিনিই ছিলেন সবথেকে শিক্ষিত এবং একমাত্র কালো চামড়ার সাধারণ সেনা। কিন্তু রেজিমেন্টে সবার কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন তিনি।
উচ্চ শিক্ষিত যোগেন্দ্রনাথ কেন যোগ দিলেন সাধারণ সেনা পদে? মনে করা হয়, বাঙালিদের প্রতি বিদেশীদের ঘৃণার জবাব দিতেই তিনি যে কোন মূল্যে যোগ দিতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। বাঙালি যে আদপে ভীরু জাতি নয়, এটা প্রমাণ করেছিলেন নিজের জীবন দিয়ে। সেই সময়ে তিনি দেশের বাড়িতে মার কাছে ক্ষমা চেয়ে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমায় মার্জনা করিবেন, আমি বাঙালির গালে চুন কালি দিতে পারিব না।’
যোগেন্দ্রনাথ সেনের ওপর বিশেষ ভাবে গবেষণা করে এই সব অজ্ঞাত তথ্যগুলি উদ্ধার করেছেন আরেক বঙ্গ সন্তান, শান্তনু দাস। লন্ডনের কিংস কলেজের ইংরাজির এই অধ্যাপককে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বলা যায়। হুগলীর চন্দননগরের এক সংগ্রহশালায় তিনি দেখতে পান যোগেন্দ্রনাথের রক্তমাখা এক চশমা। সেখান থেকেই শুরু হয় পিছন ফিরে ইতিহাসের পাতা উলটে দেখার পালা। তিনিই প্রথম খেয়াল করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে যাঁর নাম লেখা আছে ‘জন সেন’, তিনি আসলে যোগেন্দ্রনাথ সেন।
ফ্রান্সের রণাঙ্গনে যুদ্ধ চলাকালীন ২২শে মে ১৯১৬ সালে মাঝ রাতে আচমকা শুরু হয় ভারী বোমাবর্ষণ। প্রথমে তাঁর পায়ে ও পরে গলায় আঘাত লাগে। মাত্র ২৭ বছর বয়েসে শহীদ হন নিজের বাড়ি থেকে বহু দূরে বীর বাঙালি সন্তান। ফ্রান্সের মাটিতে ফ্ল্যান্ডার্সের অ্যালবার্ট নগরে ব্রিটিশরা তাঁর দেহকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদা ও সম্মানের সাথে সমাধিস্থ করে।
যোগেন্দ্রনাথ সেনের মৃত্যুর পর লিডসের মেয়র তাঁর বড় ভাই ডাক্তার যতীন্দ্রনাথ সেনকে চিঠি লেখেন, “জন সেনকে পেয়ে তাঁরা ধন্য। তাঁর বীরত্ব ও পারদর্শিতা প্রশংসনীয়।”
তিনটি সামরিক মেডেল, তাঁর ব্যবহৃত ঘড়ি, পকেট কেস, তামাকের পাইপ ও বীরের রক্তমাখা চশমা তাঁর দাদাকে পাঠিয়ে দেয় ব্রিটিশরা। যোগেন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত চন্দননগরের সেই শতাব্দি-প্রাচীন বাড়ি এখনও আছে। আছে তাঁর কালো গাউন পরা এক সাদাকালো ছবি। আর সংগ্রহশালায় রয়ে গেছে সেই জিনিসগুলিও। তোমরা যে কোন দিন গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসতে পার। গল্প নয়, সত্যিকারের এক বীর বাঙালি যোদ্ধাকে।।
তথ্যসূত্র – https://eisamay.indiatimes.com/city/kolkata/the-forgotten-bangali-army-of-world-war-ii-in-british-documentary/articleshow/46525899.cms ও উইকিপিডিয়া।