ঘন অ্যাসিডমেশা জলের ধারা নেমে আসছিল উল্কার আঘাতে ছিন্নভিন্ন গ্রহটার আদিম মাটিতে। তার ফুটিফাটায় জড়ো হওয়া সেই জলের বুকে তখন ঘটে চলেছে এক গোপন পরীক্ষা। নক্ষত্রের আলোর অতিবেগুণি রশ্মিতে উত্তপ্ত উল্কাভস্ম আর ধুলোর মিশেলের দ্রবণের থেকে একে একে জন্ম নিচ্ছে কিছু নতুন পদার্থ। ধাবমান জলধারা সেই বস্তুগুলিকে বয়ে নয়ে ধেয়ে যায়, ছুটন্ত রাসায়নিকগুলি একে অন্যের কাছে আসে—আরো কাছে- তারপর একে অন্যের হাত ধরে তারা—তারপর—হঠাৎ কোন এক জাদুদন্ডের স্পর্শেই যেন, তারা টের পায়—বেঁচে আছি পৃথিবীর বুকে—
আকাশ থেকে ফুল ছিটোননি দেবতারা, কারণ ফুল তৈরি হতে তখনো বহুকোটি বছর দেরি। কিন্তু তবু সেই ছিল পৃথিবীর জীবনের সেরা দিন। সেদিন তার বুকে প্রাণের স্পন্দন জেগেছিল–
প্রাণ শুরু হতে কোন কোন রাসায়নিক লাগে জানো?
তাদের নাম নিউক্লিক অ্যাসিড, অ্যামাইনো অ্যাসিড আর লিপিড।
এই তিনটে উপাদান একত্র হয়েই সৃষ্টি হয়েছিল আদি কোষ, যা নিজের মতন দেখতে অন্য কোষ বানিয়ে ফেলতে সক্ষম। এই তিনটে জিনিসই আজও সমস্ত প্রাণীর শরীর গঠনের অন্যতম প্রধান তিনটে মূল উপাদান।
ইংল্যান্ডে গত দশকে সাদারল্যান্ড নামে এক বিজ্ঞানি পরীক্ষায় প্রমাণ করেছেন, হাইড্রোজেন সায়ানাইড, (এক অণু করে হাইড্রোজেন, কার্বন আর নাইট্রোজেন মিলে তৈরি একটা যৌগ) হাইড্রোজেন সালফাইড (দুই অণু হাইড্রোজেন আর এক অণু সালফার) একত্রে নিয়ে অতিবেগুণি রশ্মি দিয়ে তাকে উত্তেজিত করলে তৈরি করা যায় নিউক্লিক অ্যাসিডের সূচক রাসায়নিক। একই পদ্ধতিতে যে আমাইনো অ্যাসিড আর লিপিড তৈরির মূল উপাদানগুলোরও সৃষ্টি সম্ভব তা-ও প্রমাণ করে দেখিয়েছেন সাদারল্যান্ড।
এসো সাদারল্যান্ডের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে, সেই উল্কা আক্রমণের মহাপ্রলয়ের যুগে কেমন করে প্রাণের অংকুর প্রথম মাথা তুলল পৃথিবীর বুকে তার একটা গল্প তৈরি করি।
পৃথিবী তখন ঠান্ডা হয়ে এসেছে আরো একটু। বাতাসে ভেসে থাকা গ্যাসদের মধ্যেকার জলীয় বাষ্পেরা ঘন হয়ে বৃষ্টির চেহারা নিয়ে ঝরে পড়া শুরু করেছে আদিম সেই প্রাণহীন পৃথিবীর বুকের ওপর। উল্কাপাতের কুড়ি কোটি বছরের লম্বা যুগ প্রায় শেষ। পৃথিবীর এবড়োখেবড়ো গহবরগুলোতে জল জমে জমে তৈরি হচ্ছে অতিকায় সব জলাশয়। বৃষ্টির ধারা ফাটাফুটির মধ্যে দিয়ে বয়ে চলে গিয়ে জমা হচ্ছে সেইসব জলাশয়ের বুকে।
সূর্য থেকে যে আলো পৃথিবীর বুকে এসে পড়ে তার মধ্যে অতিবেগুণি রশ্মি থাকে অনেকটাই। এ রশ্মি আমাদের চামড়ার পক্ষে বেজায় ক্ষতিকর। তবে তা থেকে আমাদের বাঁচায় উর্ধ্বাকাশে ভেসে থাকা ওজোন গ্যাসের সুরক্ষাবলয়। ওজোন হল, তিন পরমাণু অক্সিজেন মিলে তৈরি একটা অণু। সে সময়ের আবহমণ্ডলে অক্সিজেন ছিল না মোটে। কাজেই ওজোনও বলা বাহুল্য, ছিল না একেবারে। সূর্য থেকে আসা অতিবেগুণি রশ্মি তাই তখন নিশ্চিন্তে ঝরে পড়ত পৃথিবীর বুকে।
পৃথিবীর হাওয়ায় তখন ছিল প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেন সালফাইড। আর, তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া উল্কার স্রোত বয়ে এনেছিল প্রচুর হাইড্রোজেন সায়ানাইড। এইবারে, এই তিন বস্তুর বিক্রিয়া আবার ভিন্নভিন্নভাবে হলে কোনটায় তৈরি হয় অ্যামাইনো অ্যাসিড, কোনটায় তৈরি হয় নিউক্লিক অ্যাসিড আবার কোনোটায় তৈরি হয় লিপিড, প্রাণ তৈরির তিনখানা প্রধান উপাদান। দেখা গেছে বিভিন্ন ধাতুর উপস্থিতিতে এই একেক ধরণের বিক্রিয়াগুলো ঘটে।
ভুপৃষ্ঠের একেক জায়গায় উল্কাদের বয়ে আনা নানান ধাতুর স্তর জমে উঠেছে তখন। তাদের উপস্থিতিতে অতিবেগুণি রশ্মির উনুনে পৃথিবীর হাইড্রোজেন সালফাইড আর উল্কাদের বয়ে আনা হাইড্রোজেন সায়ানাইড বিক্রিয়া করে গড়ে তুলছিল—কোথাও অ্যামাইনো অ্যাসিড, কোথাও লিপিড আবার কোথাও বা নিউক্লিক অ্যাসিড। বহমান জলধারা তাদের ধুয়ে সঙ্গে করে এনে জমা করছিল অতিকায় জলাশয়গুলোতে। তাদের আমরা এখন সমুদ্র নামে ডাকি। আর সেইখানে এই তিন মূল উপাদান মিলেমিশে যেতেই—ঘটে যাচ্ছিল সেই আশ্চর্য ম্যাজিক যার আর কোন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় নি এখনো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে—জন্ম হচ্ছিল প্রাণের।
প্রথম সৃষ্টি হওয়া সেই প্রাণকণারা এইবার দ্রুত কাজ শুরু করে দিল। বাঁচবার জন্য অক্সিজেন লাগত না তাদের। কিন্তু বাতাসের বিচ্ছিরি কার্বন ডাই অক্সাইডদের ধরে ধরে হজম করে তার থেকে অক্সিজেন তৈরি করে ক্রমাগত বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দিচ্ছিল তারা, তৈরি হচ্ছিল আগামীদিনের অক্সিজেন ব্যবহারকারী জীবজগতের আঁতুরঘর। একদিন সেই ঘর থেকে বের হয়ে এসে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়াবে আজকের মানুষ। তবে সে অনেক পরের কথা। সে গল্প পরে কখনো হবে’খন।
বাঃ আরও চলুক এই লেখা।
LikeLike